Boxing : তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথম পেশাদার বক্সার
Boxing : তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথম পেশাদার বক্সার |
তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথম পেশাদার বক্সার
নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘বেক্সিমকো এক্সেল বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ (এক্সবিসি) ৩.০’। ২৫ মে আন্তর্জাতিক প্রফেশনাল বক্সিং নাইটের এই আসর বসেছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। সেখানে সুপার মিডল ওয়েট ক্যাটাগরিতে নাম লিখিয়েছিলেন ইমন তঞ্চঙ্গ্যা। তাঁর প্রতিপক্ষ মাহদী সারভাজ ইরানের সাতবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন।
বয়সেও ইমনের চেয়ে প্রায় ১০ বছরের বড়। অন্যদিকে ইমনের এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ! তাই দুরুদুরু বুকে বক্সিং রিংয়ে ঢুকেছিলেন ইমন। কিন্তু খেলা শুরুর পর সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মতো ‘বিরাট দুঃসাহসেরা’ যেন উঁকি দিয়েছিল ১৮ বছর বয়সী ইমনের মধ্যে। মাহদীর সঙ্গে দুর্দান্ত লড়ে সেদিন নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় ছিনিয়ে নেন তিনি।
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর প্রথম পেশাদার বক্সার তিনি। এর মধ্য দিয়ে রাঙামাটির সুর কৃষ্ণ চাকমার পর পাহাড় থেকে আরেক পেশাদার বক্সার পেল দেশ।
বড়দের সঙ্গে খেলতেন
ইমন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) দ্বাদশ শ্রেণির প্রশিক্ষণার্থী। বান্দরবানের আলীকদমের বুলু কার্বারি পাড়ায় জন্ম তাঁর। বাবা প্রদীপ তঞ্চঙ্গ্যা আর মা ননীমালা তঞ্চঙ্গ্যা। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। গ্রামের বড় ভাইদের সঙ্গে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতেন। বয়সে ছোট হলেও বড়দের সঙ্গে টেক্কা দিতেন সমানে। বঙ্গবন্ধু স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টেও উপজেলা পর্যায়ে সেরা হয়ে জেলা পর্যায়ে খেলেছেন।
বড় ভাই প্রণয় তঞ্চঙ্গ্যা বান্দরবান সদরে পড়াশোনা করতেন। একসময় স্কুল বদলে ইমনও চলে যান সেখানে। ভর্তি হন বীর বাহাদুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বান্দরবানে আসার পর ইমন দেখলেন, বিকেল হলেই প্রণয় চলে যাচ্ছেন বান্দরবান স্টেডিয়ামে। সন্ধ্যায় ফেরার পর বাসায় ঝোলানো পাঞ্চিং ব্যাগে ঢিসুম ঢিসুম মারছেন! ভাইকে দেখে খেলাধুলায় নতুন উৎসাহ জাগে ইমনের। একদিন ভাইয়ের কাছে আবদার করে তাঁর সঙ্গে চললেন স্টেডিয়ামে। ইমন একটু অবাক হয়েই দেখলেন, ফুটবল কিংবা ক্রিকেট নয়, তাঁর ভাই ব্যস্ত অন্যদের সঙ্গে ‘ঘুষাঘুষি’তে! পরে জানলেন, এই খেলার নাম বক্সিং। তখন তাঁরও আগ্রহ হলো এই ‘ঘুষাঘুষির’ খেলায়। ছোট ভাইয়ের আগ্রহ দেখে পরে প্রণয় তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বান্দরবান স্টেডিয়ামসংলগ্ন ঘামা বাচ্চু বক্সিং ক্লাবে। সেখানে বক্সিং কোচ আলেক রশিদ বাচ্চুর অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে লাগলেন ইমন। তখন থেকে টিভিতে বক্সিংয়ের কোনো অনুষ্ঠানই মিস করতেন না। বক্সিং হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
স্টাইলে নজর কাড়লেন
বছর কয়েক আগের কথা। বক্সিং ফেডারেশন আয়োজিত জুনিয়র ন্যাশনাল বক্সিং কম্পিটিশনের জন্য বান্দরবানের আটজনের দলে সুযোগ পেলেন ইমন। জেলা পর্যায়ে সেরা হয়ে তাঁরা পরে বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামে খেলতে যান। সেখানেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে পৌঁছান জাতীয় পর্যায়ে। ২০১৭ সালের মার্চে চূড়ান্ত পর্বের আসর বসেছিল বিকেএসপিতে। ৪৫ কেজি ওজন ক্যাটাগরিতে তৃতীয় হয়েছিলেন ইমন। তাঁর লড়াইয়ের ধরন ভালো লেগে যায় বিকেএসপির বক্সিং কোচদের। তাঁদেরই একজন আবু সুফিয়ান চিশতী বাবু। খেলা শেষে তিনি এসে ইমনের পিঠ চাপড়ে দিলেন। ইমনের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলেন। জানালেন, সামনে নতুনদের নিয়ে আয়োজিত এক মাসের ক্যাম্পে ডাকা হতে পারে তাঁকে।
স্বপ্নের পথে বাধা
এর মধ্যে ইমনের বাবা প্রদীপ তঞ্চঙ্গ্যা কাজ করতে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। শুরুর দিকে তাঁকে সেখানে কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। ইমনের মা খরচ কুলাতে না পেরে বান্দরবান শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। ইমনের বক্সার হওয়ার স্বপ্নে ধাক্কা লাগলেও হাল ছাড়েননি তিনি। বাসায় নিজে নিজে অনুশীলন চালিয়ে গেছেন। একদিন বিকেএসপি থেকে ৪০ জনের ক্যাম্পে অংশ নিতে ডাক এলো। ইমনের মা ধারদেনা করে ছেলেকে কাকার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন সাভারের বিকেএসপিতে। সেখানে মনোযোগ দিয়ে ক্যাম্প করলেন ইমন। কোচদের মূল্যায়নে ভালো নম্বর পেলেন। এক মাসের ওই ক্যাম্প থেকে নির্বাচিত ছয়জনকে নিয়ে পরে বিকেএসপিতেই আরো চার মাসের ক্যাম্প হয়। সেখানেও ডাক পেলেন আলীকদমের এই তরুণ। চার মাসের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শেষে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের ডাকা হলো আরো সাত দিনের ক্যাম্পে। সেখানেও ছিলেন ইমন।
অবশেষে এলো সুখবর
সফলভাবে সাত দিনের ক্যাম্প শেষ করার পরই বড় সুখবর পেলেন ইমন। ২০১৮ সালে বিকেএসপিতে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলেন তিনি। শুরু হয় মুষ্টিযোদ্ধা হওয়ার পথে তাঁর স্বপ্নযাত্রা। ‘বিকেএসপিতে ভর্তির পরই আসলে বক্সিংয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে পারি। ঠিক করলাম—আর কিছু না। জীবনে বক্সারই হব।’ তখন থেকে বিকেএসপির রুটিনমতো পড়াশোনার পাশাপাশি সকাল-বিকেল দুই বেলা অনুশীলন চলতে লাগল। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই চলতে লাগল কোচদের গাইডলাইন অনুযায়ী।
পেশাদার জগতে পা
একে একে জুনিয়র ন্যাশনাল, বিকেএসপি কাপ, বিজয় দিবস কাপসহ অ্যামেচার বা শৌখিন হিসেবে চারটি টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পান ইমন। সেখানে ভালো করেন। ২০২৩ সাল থেকে পেশাদার বক্সিংয়ে নাম লেখান তিনি। এ পর্যন্ত খেলা তিন ম্যাচেই জিতেছেন। আর ২৫ মে তো জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচেও বাজিমাত করলেন।
কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ম্যাচটির জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন ইমন। রিংয়ে নামার আগে অবশ্য নার্ভাস ছিলেন। কিন্তু লড়াই শুরুর পর সব ভয় উবে যায়। ‘কেবল মনে হচ্ছিল আমাকে জিততে হবে’, বললেন ইমন।
ইমনের কোচ ও বিকেএসপির বক্সিং বিভাগের ইনচার্জ আরিফুল করিম ভাষণ বললেন, ‘ও খুব সম্ভাবনাময় একজন বক্সার। খেলোয়াড়সুলভ আচরণ ওর মধ্যে আছে। খুব সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করে। সামনে লম্বা সময় পড়ে আছে। আশা করছি, সুর কৃষ্ণ চাকমাসহ দেশের অন্য বক্সারদের ছাড়িয়ে যাবে ইমন।’
চেনাতে চান নিজ জনগোষ্ঠীকে
এত দূর আসার পেছনে ইমন কৃতজ্ঞ বিকেএসপির কাছে। গ্লাভস, ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে খেলার সব সরঞ্জাম পেয়েছেন জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি থেকেই। ‘বিকেএসপিতে সুযোগ না পেলে হয়তো এত দূর আসতেই পারতাম না আমি।’
কিছুদিন পরই ইমনের এইচএসসি পরীক্ষা। এরপর পেশাদার ম্যাচে অংশ নিতে যাবেন থাইল্যান্ডে। আগস্টে লন্ডনে তিন সপ্তাহের এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেও যাওয়ার কথা তাঁর। ভবিষ্যতে বক্সিংয়ের মাধ্যমে নিজের জনগোষ্ঠীর নাম ছড়িয়ে দিতে চান ইমন। বললেন, ‘পাহাড়ের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আড়ালে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো কিংবা খুমির মতো সংখ্যায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো। বক্সিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীর কাছে নিজ জনগোষ্ঠীর নাম পৌঁছে দিতে চাই আমি।’
হাঙ্গামা/শিমু