ঢাকায় যেভাবে এল ব্যান্ড সঙ্গীত || মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না
![]() |
ঢাকায় যেভাবে এল ব্যান্ড সঙ্গীত || মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না |
ঢাকায় যেভাবে এল ব্যান্ড সঙ্গীত || মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না
ঢাকায় রক মিউজিক বা ব্যান্ড কালচারের আঁতুড়ঘর বলা যায় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলকে। ব্যান্ড জমানার শুরুর প্রথম ব্যান্ডের যে যাত্রা শুরু হয়েছে এই স্কুল থেকে। তাও এর মধ্যে প্রথম ব্যান্ডটি শুরু করেন ক্লাস এইটে পড়ুয়া বাচ্চা এক ছেলে। তিনি হলেন ফজলে রব। সেটা ১৯৬৪ সালের কথা। একদিন এক অনুষ্ঠানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধু ১৭ বছর বয়সী টেলফার জনসনকে শুনলেন ক্লিফ রিচার্ডসের একটা গান বেশ যুৎসই ভাবেই গেয়ে যাচ্ছেন। সেই থেকে আসলো ‘আইডিয়া’!
তখনই নিজের ইলেক্ট্রিক গিটারটা নিয়ে আসলেন। নিজের আরো কয়েকজন গানবাজনা প্রেমী বন্ধু মিলে শুরু করলেন ঢাকার ইতিহাসের প্রথম ব্যান্ড – আইওলাইটস। শিগগিরই তারা শাহবাগ হোটেল ও ঢাকা ক্লাবে পারফর্ম করা শুরু করলেন। বলা হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম দেশি ব্যান্ড হিসেবে টিকেট কেটে লোকে তাদের কনসার্ট দেখতে গিয়েছিল। ব্যান্ডটা হাজির হয়েছিল টেলিভিশনের পর্দায়ও। ‘আইওলাইটস’কে অনেকে ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ নামেও চিনতো। লিড গিটারিস্ট ফজলে রব ছাড়া ব্যান্ডটিতে ছিলেন আলমগীর, রফিক মাজহার ইসলাম সাজু (রিদম), বেজ গিটারিস্ট রাফি ফাহমি ওমর ও খাঁজা সাব্বির কাদের। খাজা সাব্বির ছিলেন ড্রামার, তার আরেকটা পরিচয় তিনি ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য। খাজা সাব্বির কাদের ১৯৬৮ সালে তিনি ‘গোরি’ নামের একটা সিনেমায় নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাটা ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি, যদিও তিনি বোম্বে টকি থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি স্থায়ী ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। ১৯৯১ সালে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
‘দ্য লাইটনিং’ নামের আরেকটি ব্যান্ড এসেছিল কাছাকাছি সময়ে। তারাও টেলিভিশন শো করেছিল। দলনেতা ছিলেন আব্দুর রশিদ, আরো ছিলেন নিও মেন্ডিস, নোয়েল মেন্ডিস ও শাকিল। সবাই ছিল চিটাগংয়ের সেন্ট প্লাসিড স্কুলের শিক্ষার্থী। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হোটেল আগ্রাবাদে তারা পারফর্ম করেছিল। মোটামুটি চট্টগ্রাম কেন্দ্রিকই ছিল এই ব্যান্ডটি। এই চট্টগ্রামে ব্যান্ড সঙ্গীতের যাত্রা শুরু হয় ঢাকার এক বছর আগেই। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজের কয়েকজন ছাত্র মিলে শুরু করেন ‘জিঙ্গা শিল্পগোষ্ঠী’ নামের একটি অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড। ১৯৬৬ সালে আসে বাংলা সিনেমার বিখ্যাত নায়ক, পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাফর ইকবালের ব্যান্ড ‘র্যাম্বলিং স্টোন্স’। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বর্তমানে হোটেল শেরাটন চাম্বেলি রুমে তারা পারফর্ম করতেন নিয়মিত। এই মঞ্চটা ছিল ওই সময়কার ব্যান্ডের স্বপ্নের জায়গা।
জাফর ইকবাল শৈশব থেকে নিজের আদর্শ মানতেন এলভিস প্রিসলিকে। ক্লাস সেভেনে থাকা অবস্থাতেই গিটার হাতে নেন। স্কুল-কলেজে নিয়মিত এলভিস প্রিসলির গান করতেন। এমনকি ‘পিচ ঢালা পথ’ গানে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষ তাকে সিজন গিটারিস্ট হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন। ব্যান্ডে আরো ছিলেন মাহমুদ, ফারুক ও তোতা। ১৯৬৯ সালে তাদের অনুশীলন করার জায়গা পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। তার জের ধরে ব্যান্ডও ভেঙে যায়। ১৯৬৫ সালে ফজলে রব আয়োল্যাক্স নামের আরেকটি ব্যান্ড করেন। রবের বন্ধু ছিলেন ওমর খালেদ রুমীর বন্ধু। রুমী হলেন সাবেক ক্রিকেটার ও মিউজিশিয়ান। এক সাক্ষাৎকারে সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বন্ধু ফজলে ১৯৬৫ সালে ব্যান্ড করে আয়োল্যাক্স। একদিন শো দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, গিটার বাজাতে না পারলে আমার জীবন বৃথা।’
এই রুমী আবার ছিলেন জিংগা ব্যান্ডে। হিসাব মতে, এই জিঙ্গাই স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম ব্যান্ড। যদিও, এই ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। ১৯৬৮ সালে চাম্বেলি রুমে তিন ব্যান্ড – আইওলাইটস, লাইটনিং ও র্যাম্বলিং স্টোনসকে নিয়ে এক প্রতিযোগীতা হয়েছিল। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ নাম নিয়ে অংশ নেওয়া ইয়োলাইট। তখন আরসিএ রেকর্ড কোম্পানি তাদের এ্যালবাম বের করার প্রস্তাব করেছিল। ইউটিউবে এখনো তাদের একটা ‘ইন্সট্রুমেন্টাল’ পরিবেশনা পাওয়া যায়। তখন ব্যান্ডের ভোকাল ছিলেন আলমগীর। তিনি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন, বিএএফ শাহীন কলেজেও ছিলেন কিছুকাল। ৭০-এর দশকে ১৫ বছর বয়সে তিনি চলে যান পাকিস্তানের। পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। সেখান থেকে আমেরিকায়। পরবর্তীতে পাকিস্তানে ফিরে পপ সঙ্গীতে জনপ্রিয়তা পেলেও, কখনো স্থায়ী ভাবে বাংলাদেশে ফেরেননি, তবে গেয়েছেন বাংলা গানও।
সেকালের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ষাটের দশকে ঢাকায় বাকি ব্যান্ডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আগলি ফেসেস, টাইম অ্যাগো মোশন রবিন ও অন্যরা, ফায়ার অ্যান্ড আইস ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত, সদস্যরা হলেন সেলিম আলম, রেজা আহমেদ, ছোটন ইসলাম ও হাবিব জাফরুল্লাহ মিঠু ও ইনসেক্স ডু্ ঢাকার আমেরিকান স্কুলে আমেরিকান ছাত্রদের ব্যান্ড। টাইম অ্যাগো মোশন মূলত র্যাম্বলিং স্টোন্স ভাঙার পর গড়ে ওঠে। যদিও, ওই সময় আজকের দিনের মত দামি ও আধুনিক বাদ্য যন্ত্র, কিংবা সাউন্ড সিস্টেমের কথা ভাবাই যেত না। বাংলা গানের থেকে, ইংরেজি গানই চলতো বেশি। সে আমলে নারায়নগঞ্জে একটা ব্যান্ড ছিল। নাম ‘বকলম’। দলনেতা ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক গিটারিস্ট জালাল আবেদিন, দারুণ বাজাতেন বলে জনশ্রুতি আছে। এভাবেই সূচনা হয় ঢাকায় ব্যান্ড সঙ্গীতের।
হাঙ্গামা/অর্নব