Hawa : এক নৈরাজ্য ভরা ভাসমান সমুদ্র থেকে বলছি

গত ২৯ জুলাই সারাদেশব্যপী মুক্তি পেয়েছে বহুল প্রতিক্ষিত চলচ্চিত্র 'হাওয়া'। আলোচিত নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালনায় এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ, নাজিফা তুষি, নাসির উদ্দীন খানসহ আরো অনেকেই। আলোচিত এই সিনেমাটি দেখে ব্যক্তিগত অভিমত জানিয়েছেন চলচ্চিত্র সমালোচক মিজানুর রহমান আরিয়ান। তার লেখা আলোচনা মূলক নিবন্ধটি হাঙ্গামা২৪ এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
হাওয়াঃ এক নৈরাজ্য ভরা ভাসমান সমুদ্র থেকে বলছি || মিজানুর রহমান আরিয়ান
হাওয়াঃ এক নৈরাজ্য ভরা ভাসমান সমুদ্র থেকে বলছি || মিজানুর রহমান আরিয়ান

হাওয়াঃ এক নৈরাজ্য ভরা ভাসমান সমুদ্র থেকে বলছি || মিজানুর রহমান আরিয়ান


রিলিজ হওয়ার আগে হাওয়া নিয়ে যেমন আমি একদিকে এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম, তেমনি অন্যদিকে ভয়ও হচ্ছিলো। নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন গ্রাজুয়েশন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে। ছবি আঁকতে পারেন, গিটার বাজিয়ে গান গাইতে পারেন। আর্টের সবগুলো গুণ তার মধ্যে রয়েছে। সুমন যখন নাটক তৈরি করেছিলেন, তখন সেগুলো গণমানুষের মানুষের জন্য বানাননি। মেটাফোরিকাল কাজ দেখিয়ে তিনি ফিল্ম মেকিংয়ের প্রথা ভেঙেছেন। বিকল্পধারায় স্টোরিটেলিং নিয়ে খেলেছেন। তিনি যেটা বিশ্বাস করতে পেরেছেন সেই গল্পটাই পর্দায় দেখিয়েছেন। তাই যারা টুকটাক ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং নিয়ে চিন্তা করেন, ভুল ক্রুটি খন্ডন করতে জানেন, তাদের জন্যেই শিল্পচর্চা সুমনের। তাই তো ছবির রিলিজ হওয়ার আগেই সুমন বলে দিয়েছিলেন, “ছবিটি সকলের ভালো নাও লাগতে পারে”! 

ছবিটিকে ঘিরে দর্শকদের যে উন্মদনা তৈরি হয়েছিলো, সেটা ছবিটির প্রোমোশনে ব্যবহৃত অভিনব সব কৌশলের জন্য। আর্টিস্টিক পোস্টার, দুর্দান্ত ট্রেইলার, হাতে আঁকা ক্যারেক্টারইজেশন পোস্টার, ও  “তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেনো কী, বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি” গানের গীতিকার হাশিম মাহমুদের মতো শিল্পীর নিভৃতে থাকা জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশিত হওয়ার পর ম্যাস অডিয়েন্সকে গভীরভাবে ছুঁয়ে দিয়েছে। ছবি দেখার জন্য দর্শকরা অগ্রিম টিকিট কেটে ফেলেছে, প্রথম সাপ্তাহের টিকিট নেই অনেক জায়গায়। এরকম রেকর্ড বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে দুর্দান্ত একটি মাইলফলক অতিক্রম করলো নিঃসন্দেহে। 

হাওয়া নিয়ে আমার এক্সপেকটেশন ছিলো অনেক। যতো প্রকার ভয় ছিলো সব ভেসে গেছে সমুদ্রের নৈরাজ্যের মাছ ধরার নৌকা থেকে সুমনের উপস্থাপনায়। গল্পটা ছোট করে বললে চান মাঝি সর্দারগোছের একজন। মাঝ দরিয়ায় মাছ ধরেন। গল্পটা নির্দিষ্টভাবে কোনো ঘরানায় আবদ্ধ করা যায় না। গল্পে বাকবিতন্ডা আছে, আছে প্রেম, আছে রহস্যের জাল। তাই হাওয়ার গল্পটা যেনো আধুনিক রূপকথা। চাঁদ সওদাগর ও মনসার পুরাণ কাহিনীর মর্ডান ভার্সন বলা যেতে পারে। তবে এ রূপকথা না জানলেও গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়তে অসুবিধে হবে না। চান মাঝি, গুলতি, নাগু, ইব্রাহিম, উরকেস পারকেস একেকটি শক্তি এখানে। তাদের শক্তিকেন্দ্র করেই ছবিটার মূল আকর্ষণ। 

গল্পের ফার্স্ট হাফের গাঁথুনি শ্লথ গতিতে এগোলেও, তবে বেশ মজবুত। চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরপরই তাদের কার্যক্রম দেখিয়ে, তাদের বিল্ড আপ করা হয়েছে, সময়ে সময়ে রহস্য জমেছে, কমিক ডায়লগ হাসির খোরাক করেছে। দ্বিতীয় হাফটা খুবই দ্রুত গতির। মনোরম পরিবেশ ও ভায়োলেন্স দৃশ্যগুলো আপনাকে টেনে ধরবে, কোনোভাবেই স্ক্রিন থেকে চোখ সরানোর উপায় নেই। মাঝেমধ্যে আঁতকে উঠবেন এগুলো কী হচ্ছে! সুমন এন্ডিংটাও রেখেছেন বুদ্ধিদীপ্ততায়। এরচেয়ে ভালো এন্ডিং হতে পারতো না। 

প্রত্যেকটি অভিনেতার পারফরম্যান্স এককথায় দুর্দান্ত। চঞ্চল চৌধুরী নিঃসন্দেহে অভিনয়ে সবার থেকে এগিয়ে থাকবেন। তার ভয়ার্ত এক্সপ্রেশন। সিগারেট খেতে খেতে বলা ডায়লগ “ভয় পাচ্ছিস”? সত্যিই ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করে। নাজিফা তুষির চরিত্রটা অনেক রহস্যের বেড়াজালে বন্দী। তাকে ভাবনায় কোনোকিছু দিয়ে ধরে রাখা যায় না। অভিনয়ে তুষি পুরোটাই দিতে পেরেছেন। নজরকাঁড়া চাহনি, অ্যাকশন সিনগুলোতে খুবই দুর্দান্ত সে। তুষির ক্যারিয়ার সেরা অভিনয় নিশ্চয়ই। 

ইব্রাহিম চরিত্রে শরিফুল রাজের অভিনয়ও দুর্দান্ত। পরাণের পর আরেকটি চরিত্র এভাবে ফুটিয়ে তুলতে খুব কম সংখ্যক অভিনেতাকে দেখেছি। শরিফুল রাজের মধ্যে চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার দুর্দান্ত স্কিল রয়েছে। নাগু, এজা চরিত্রে (সুমন আনোয়ার ও নাসির উদ্দিন খান) খুবই চমৎকার। সাপোর্টিং ফিলার চরিত্রগুলো অতোটা জায়গা না পেলেও একটা স্থান দখল করে নিয়েছেন উরকেস, পারকেস চরিত্রে সোহেল মন্ডল এবং রিজবি রিজু চৌধুরী। রিজবি রিজুর পারফরম্যান্স আমার কাছে দারুণ লেগেছে। 

এডিটিং টেকনিকেও নতুনত্ব দেখিয়েছে এই সিনেমা। ছোট ছোট শট খুব সূক্ষ্মভাবে সংকলন করে গল্পের গতিকে ধরে রাখতে পেরেছে। পাশাপাশি শব্দের ব্যবহারে নির্মাতা দেখিয়েছেন অভিনবত্ব। সমুদ্রের আবহ উপস্থাপন করতে গিয়ে অযথা লং শটের কারিসমা দেখায়নি। অপ্রয়োজনীয় কোনো দৃশ্যায়নও রাখা হয়নি। ভায়োলেন্স দৃশ্যগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর পারফরম্যান্স আনবিলিভেবল। গল্পটার এন্ডিং চেনা ছকে গিয়ে হয়তো রিভেঞ্জ থ্রিলারের আদলে করতে পারতো, কিন্তু তা দেখানো যে আবশ্যক নয়- তার প্রমাণ দিয়েছেন নির্মাতা। গভীর সমুদ্রে ঘোর লাগা অনূভুতি। আইয়ো আইয়ো সাউন্ড, এখনও মাথা থেকে সরাতে পারছি না৷ এখানে কী দারুণভাবে অ্যাম্বিয়েন্স আর ফলি সাউন্ডের সমন্বয় দিয়ে ভিজ্যুয়ালাইজ করানো যায়, সেই সাক্ষ্যও দেয় হাওয়া।

হাঙ্গামা/মিজানুর রহমান আরিয়ান
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url