Hawa : মেকিংয়ে গত এক যুগের সব বাংলা সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে

গত ২৯ জুলাই সারাদেশব্যপী মুক্তি পেয়েছে বহুল প্রতিক্ষিত চলচ্চিত্র 'হাওয়া'। আলোচিত নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালনায় এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ, নাজিফা তুষি, নাসির উদ্দীন খানসহ আরো অনেকেই। আলোচিত এই সিনেমাটি দেখে পর্যালোচনা লিখেছেন রাফি আদনান। তার লেখা পর্যালোচনা অথবা রিভিউটি হাঙ্গামা২৪ এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
মেকিংয়ে গত এক যুগের সব বাংলা সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে || রাফি আদনান
মেকিংয়ে গত এক যুগের সব বাংলা সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে || রাফি আদনান

মেকিংয়ে গত এক যুগের সব বাংলা সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে || রাফি আদনান


জনরা
মুভিটাকে আপনি জনরায় ফেলতে গেলে ট্রেইলার দেখেই বুঝবেন এটা ড্রামা মুভি। মুভি দেখলে আপনার এই ধারণায় আরো সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে মুভির ডিরেক্টর। তখন আপনি মুভিটাকে মিস্ট্রি ক্যাটাগরিতেও নিয়ে যাবেন। সাথে সামথিং ফ্যান্টাসি কারণ অনেকটা মিথ টাইপ ক্যারেক্টার বিদ্যমান। তবে অভার-অল ড্রামা মিস্ট্রি জনরার ফিল্ম এটা।

আমার পার্সোনালি মুভিটা ভালো লেগেছে বলতে পারি। হাওয়া মুভিটা আসলে স্লো-বার্নের সিনেমা, আস্তে আস্তে স্টোরি এগিয়ে জমে উঠা টাইপ। তবে তাতেও শুরু থেকে অডিয়েন্স ধরে রাখার মতো যথেষ্ট উপাদান ছিলো। এখন আপনি যদি মাসালা টাইপ স্টোরি বা অবজেক্ট অথবা টোন খুঁজেন মুভিতে তাহলে বলবো, এগুলোর সবই মিসিং মুভিতে। আপনি দফায় দফায় গান পাবেন না, সাথে চোখ ধাঁধানো অ্যাকশন, রোম্যান্স কোনোটাই পাবেন না। তাহলে বলতে পারেন মুভিটা আপনার ভালোলাগবে কেনো? কারণ- পুরা মুভিতে একটা স্ট্রং আবহ ধরে রাখার চেষ্টা ছিলো। পাবেন কিছু রম্য ডায়লগ যেটা আপনার ঠোঁটে অধিকাংশ সময় ধরে মুচকি হাসি ধরে রাখবে। প্রথম হাফের পর স্টোরিতে একটা আমূল-পরিবর্তন ঘটেছে যেটা আপনার ভালোলাগতে বাধ্য। আছে সিনেমাটোগ্রাফি, সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, এবং প্রায় সবার অসাধারণ অভিনয়।

সিনেমাটোগ্রাফি:
স্থানভেদে কিছু কিছু শট ছিলো খুবই ইমপ্রেসিভ। যেমন প্রথম দিকে যখন নোঙ্গরের লোহাটা পানিতে ফেলে তখন নোঙ্গরের সাথে ক্যামেরার শটটাও পানির নিচ পর্যন্ত যাচ্ছে। দেখেই আমার মুখে চলে এসেছে, বাহ! ওপেনিং সিনের বিশ্বাসের ঔষধ ফেরীওয়ালার দৃশ্য থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কয়েক ডজন শট আছে যেটা চোখে পড়ার মতো। মুগ্ধ হওয়ার মতো।

স্টোরি:
মুভির প্রথম অর্ধেকে মেইন উপাদানই ছিলো ডায়লগ। প্রায় সব ডায়লগে আপনার মুখে হাসি লেগেই থাকবে। নাসিরুদ্দিনের ডায়লগে সবচেয়ে বেশী মজেছি। এছাড়া প্রথম হাফে তেমন কিছু নেই বললেই চলে, যেনো একই ফ্রেমে একই ধাঁচের স্টোরি আগাচ্ছে। স্টোরি জমেছে ২য় হাফে গিয়ে। এখানেই পরিচালক সাহেব সফল। আপনি চরমভাবে পুলকিত হবেন ২য় অর্ধেকে আশা করি।

অভিনয়:
সবচেয়ে বেশী স্ক্রিন পেয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী, এবং তার অভিনয়ে কোনো প্রশ্ন রাখেননি তিনি, পুরোদস্তুর কাঁপিয়ে অভিনয় করেছেন। সাথে অন্যান্যরা দারুন করলেও নাসিরুদ্দিন সাহেব যেনো পুরা অ্যাক্টিং গড লেভেলের চমকের সাথে মেতেছিলেন। তার একটা সিকুয়েন্স ছিলো নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার। সেখানে যা দেখালেন তিনি উফ! ঝাঁপ দেওয়ার আগে তার মুখে বিড়ি ছিলো, সে বিড়িটাকে ঠোঁট দিয়ে ভাঁজ করে মুখের ভিতরে নিয়ে গেলেন, মুখে নিয়েই ঝাঁপ। পানির নিচ থেকে অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বিঁড়িটা আবার ঠোঁট দিয়েই মুখ থেকে বের করে দিলেন বিড়িতে টান। তখনও জ্বলন্ত ছিলো বিড়িটা। এটা দেখে জাস্ট আমি হাতে তালি দিয়ে উঠেছি। রাজ, সোহেল মণ্ডল ছাড়াও বাকিরাও কোনো কমতি রাখেননি অভিনয়ে।

মেকিং:
মেকিংয়ে গত এক জুগের বাংলা সব সিনেমাকে ছাড়িয়ে গেছে আমার কাছে। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, ইডিটিং, এক ফ্রেম থেকে অন্য ফ্রেমে যাওয়ার স্মুথনেস, পারফেক্ট সব শট, মানতে হবে টপনচ ছিলো। যারা ড্রামা মুভি দেখে অভ্যস্ত তাদের চমৎকার লাগবে মুভিটা। সুমন সাহেব তার হাতের কারিশমায় মাতাইয়া রাখলেন পুরা মুভি জুড়ে। তার দীর্ঘ দিনের যত্নের মুভি এটা বোঝাই যাচ্ছিলো মুভির পরতে পরতে।

পার্সোনালি কিছু পয়েন্ট আউট
এবার একটু ভিন্নদিক দেখি। বাংলাদেশে অ্যান্থলজি বা মিথ, মাইথোলজি নিয়ে সিনেমা নেই বললেই চলে। যেখানে বলা চলে আমরা সিনেমা ডেভেলপের প্রাথমিক স্থরই পার করতে পারিনি সেখানে মিথ পুরাণের ফ্যান্টাসি নিয়ে মুভি বানানো অনেকটা স্বপ্নই বলা যায়। পরিচালক সাহেব যে ঢংয়ে গল্পকে প্রেজেন্ট করেছেন বুঝাই যায় তিনি বর্তমান জেনারেশনের চিন্তাধারা বহন করে। এবং তার মগজ জুড়ে এই মাইথোলজি কনসেপ্টটা হয়তো বহুদিন পুশে রাখা এক নির্লিপ্ত অবয়। হয়তো তিনি চমৎকার দর্শক তাই অথবা অনন্য লেভেলের অভিজ্ঞ মানুষ তাই। যেখানে হলিউডের মার্ভেল, ডিসি, স্টার-ওয়ার মিথকে কমিকের আবেশে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে সেখানে এরকম পুরাণ কনসেপ্ট আমাদের দ্বারা উপস্থাপনের সাহস করাটাই অনেক বড়ো ব্যাপার।

কিন্তু পরিচালক সেই মিথ কনসেপ্ট কে উপস্থাপনে কাইন্ড অফ ব্যর্থ বলতে পারি আমি। আরো স্ট্রং উপস্থাপন হতে পারতো। যার কারণে সাধারণ দর্শক মুভির লাস্ট দিকে প্রচুর প্লটহোল খুঁজে পাবে, মানে তাদের মনে হবে প্লটহোল। তারা বুঝেই সারতে পারবেনা কি থেকে কি হলো, কিভাবে হলো! এই ব্যর্থতার দায় কোনোভাবেই পরিচালক এড়াতে পারবেনা। তিনি পারতেন শুরু থেকে স্ক্রিন টানায় ডায়লগকেই পূঁজি না করে আরো ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটাতে।

আরো বড়ো ব্যাপার হচ্ছে, ইন্টারভেলের পরে পরিচালক সাহেব মিথ, মিস্ট্রি, হরোর, আর থ্রিল, অভিনয় দিয়ে দর্শকের মন মজিয়ে রাখতে পারলেও সেই তুলোনায় প্রথম হাফ একদমই নড়বড়ে করে রেখেছেন। এমনকি ইন্টারভেলের আগে ধাক্কা লাগার মতো কোনো সাসপেন্সও তিনি রাখতে পারেননি। একদম নরমাল টুইস্ট দিয়ে শেষ করেছে। দর্শকের এমন অবস্থা যে, টাকা দিয়ে ঢুকছি একটু ইনজয়ও করতেছি ২য় হাফ দেখেই বের হই। এমন কোনো সাসপেন্স রাখেনি যে অডিয়েন্স পুরো হতভম্ব হয়ে বসে থাকবে ২য় পার্টে কি হবে সেটা দেখতে। এখন আপনি বলতে পারেন ড্রামা ফিল্মে আবার এমন চমক আশাই বা করা যায় কিভাবে? উঁহু ভাই- মুভিটাকে পরিচালক শুধুই ড্রামায় সীমিত রাখেননি, যেহেতু সে বিশাল চ্যালেঞ্জিং একটা কনসেপ্ট নিয়েছে সো এমনটা আশা নয়, এটা দরকার ছিলো। সে পারতো VFX এর একটা দারুন ব্যবহার দেখিয়ে মিথ ক্যারেক্টারটাকে সুপার-ন্যাচারাল দেখাতে। তখনই কেবল দর্শক হা করে তাকিয়ে থাকতো।

নাজিফা তুষির অভিনয় নিয়ে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, জানিনা কে কিভাবে নিবেন। তার অভিনয় অন্য সবার তুলোনায় একদমই এভারেজ লেগেছে আমার কাছে। হয়তো অ্যাক্টিংয়ের স্কোপ কম ছিলো তার ক্যারেক্টারে অথবা তারই কমতি ছিলো। কিন্তু একদম ফেলে দেওয়ার মতো অভিনয় করেছে তাও না। চলে। বাট অন্য সবার থেকে এভারেজই লেগেছে।

আরেকটা ব্যাপার কানে বেজেছে, সেটা হচ্ছে ডায়লগ। একেকজনের ডায়লগ একেক জেলার আঞ্চলিক হয়ে যাচ্ছিলো, কারোটা ঢাকাইয়া মেশালো হয়ে যাচ্ছিলো। যেটা বারবারই কানে বেঁজেছে। তবে অতোটাও বড়ো কোনো ইস্যু নয় এটা। অনেকের অগোচরেই থেকে যাবে।

শেষ কথা:
যাইহোক, যা কিছু পয়েন্ট আমি উল্যেখ করেছি সেটা সাধারণ অডিয়েন্স অতোটা ধরতে না পারলেও মিথ নিয়ে তারা কনফিউশনে ভুগবে। এছাড়া অন্য কোনো বড়ো ইস্যু নেই। এক কথায় বলতে গেলে, মুভিটা ওভারঅল ভালো ছিলো, এবং আমার ভালোও লেগেছে।

তবে আই থিংক মুভিটা দেখার পর অডিয়েন্সদের মধ্যে তিনটা ভাগ হয়ে যাবে। এক ভাগের দর্শকদের প্রচুর ভালোলাগবে। এবং বেশীরভাগ অডিয়েন্সদের মুভিটা মুগ্ধ করবে কিন্তু উপভোগ্য করে তুলবেনা। যদি আপনি প্রতিটি অবজেক্ট সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে দেখেন। এবং আরেক ভাগের মুভিটা ভালো লাগবেনা।

সব মিলিয়ে আমার পার্সোনাল রেটিং ৭/১০

হাঙ্গামা/রাফি আদনান
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url