টিপের ইতিহাস ও ব্যবহারের উপকারিতা

টিপের ইতিহাস ও ব্যবহারের উপকারিতা
টিপের ইতিহাস ও ব্যবহারের উপকারিতা

টিপের ইতিহাস ও ব্যবহারের উপকারিতা

শিমুল চৌধুরী ধ্রুব


গত ২ এপ্রিল (শনিবার) সকালে ঢাকার ফার্মগেট এলাকা থেকে কাজে যাচ্ছিলেন লতা সমাদ্দার। তিনি তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক। তার কপালে ছিলো বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করা বড় লাল টিপ। তার এই টিপ দেখেই ক্ষেপে যান মাঝবয়সী এক পুলিশ কনস্টেবল। এই পুলিশ সদস্য লতা সমাদ্দারকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও অকথ্য গালিগালাজ করেন। এর প্রতিবাদ করলে এক পর্যায়ে প্রভাষকের পায়ের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে চলে যান ঐ কনস্টেবল।

এমন ঘটনায় তারপরদিন (রোববার) সংসদ অধিবেশন চলাকালে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাড়িয়ে তীব্র নিন্দা জানান জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা। এরপর ফুসে ওঠে সুশিল সমাজ। যার যার স্থান থেকে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান তারা। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও ওঠে ঝড়। শোবিজ অঙ্গনের অনেকেই সামিল হন এই প্রতিবাদে।

এমনকি অনেক অভিনেতাও কপালে টিপ পরে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এতে তারা রোষানলে পড়েছেন ধর্মীয় মৌলবাদী মতাদর্শের মানুষদের। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে মূলত নেটাগরিকদের মধ্যে দুটি ভাগ লক্ষ করা গেছে। একটি বাঙালী সাংস্কৃতির পক্ষে। অপরটি ইসলামী মৌলবাদীতার পক্ষে ও বাঙালী সংস্কৃতির বিপক্ষে। এতে অনেকেরই আগ্রহ জাগে এই টিপের ইতিহাসের উপর। অনেকে খুজতে থাকের এর উপকারিতা কি? তাদের জন্যই হাঙ্গামা২৪-এর এই প্রতিবেদন।

জেনে নিন টিপের ইতিহাস


প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যেও বঙ্গ-বালার শ্বাশত সুন্দর রূপের প্রতিচ্ছবি আঁকতে কাজল কালো চোখ, আর কপালে টিপের কথা বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন সাহিত্যিকেরা। টিপকে অনেকে সাহসের প্রতিক হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন নাটক-সিনেমা কিংবা সাহিত্যে। এই উপমহাদেশে টিপের ইতিহাস অনেক পুরানো।

উপমহাদেশিয় মিথগ্রন্থ বেদ, মহাভারত কিংবা রামায়ণের অনেক স্থলেই উল্লেখ করা হয়েছে নারী-পুরুষ উভয়েরই টিপ ব্যবহারের কথা। মানবসভ্যতায় বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য ভাবনার শুরু হয়। এজন্য শুধু নারীরাই নয়; পুরুষেরাও প্রসাধন এবং সাজে যত্নশীল ছিলেন। পুরুষেরা লম্বা-কোঁকড়ানো চুলে সুগন্ধি তেল মাখাতেন; নখও রাঙাতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তা আজ বিলুপ্ত।

ঋকবেদের বিভিন্ন শ্লোকে উল্লেখ রয়েছে টিপের কথা। এ থেকে বোঝা যায় প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে টিপের প্রচলন রয়েছে। ষাট-সত্তর দশকের দিকে প্রায় সব নারীরাই কপালের ভ্রু’র বেশ কিছুটা ওপরে মাঝারি কিংবা ছোট্ট টিপ পরতেন। সেখানে কোনো ধর্মীয় কিংবা জাতিগত ব্যারিকেড ছিলো না। টিপ নিয়ে ছিলোনা কোনো ধর্মীয় গোড়ামি।

ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে মানুষের মনে ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির যে বিরূপ প্রভাব বিরাজমান, তার কারণেই ভারতে হিজাব বিতর্ক কিংবা বাংলাদেশে টিপ বিতর্কের সৃষ্টি। কিন্তু সহজেই বোঝা উচিত জাতীয় সংস্কৃতি আর ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কোনো অঞ্চলের মানুষের জীবন অভ্যাস তার সংস্কৃতি, আর বিশ্বাস হলো ধর্মবোধ। তবে ধর্মবোধ জীবনে প্রভাব ফেলে এও সত্য। তাই বলে সব জাতিরই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, যা ধর্মবোধের বাইরে থেকে স্বতন্ত্র। শুধু ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে জাতি রাষ্ট্র তৈরি যে অসম্ভব, তা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিকও ছিল সাংস্কৃতিক মুক্তি।

পাকিস্তান সরকার ‘কালমে ইকবাল’ বাধ্যতামূলক করে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলাফল স্বরূপ বাঙালি মনে ক্ষোভ বেড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সনাতন জনগোষ্ঠী মুসলিম হয়নি। আবার জাতীয় কবি পূর্ব দেশের নারীর পরিচয়ে যখন লেখেন, ‘শঙ্খ নগর হতে আনিয়াছি শাঁখা, অভয় শঙ্খ। ছিল ছেনে এনেছি সুনীল কাজল, বিল ছেনে অনাবীল চন্দন পঙ্খ।’  

তখন ধর্মীয় সংস্কৃতির চোখে সনাতন নারীর রূপ দেখেন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ। একই কবি যখন লু হাওয়ায় ওড়না উড়ানো পরী নটিনীকে দেখেন, তখন আবার রক্ষণশীল সমাজের চোখে সেটা পরিচিত। কারণ পরী নটিনী বাঙালি হলেও লু হাওয়া আরব মরু থেকে আগত। সব কিছুর উর্ধ্বে জাতীয়তাবোধ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ নাগরিকের নন্দন ভাবনা একান্ত তার ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে ধর্ম, রাষ্ট্র বা আইনের বেড়াজাল না-থাকাই উত্তম।

কপালে টিপ পরার উপকারিতা


টিপ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। কপালের একটি টিপ যেন আকাশের এক টুকরো চাঁদের ফালির মতো ধরা দেয় মুখের সৌন্দর্যে। কিন্তু এই টিপই যে স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে তা অনেকেরই জানা নেই। মেয়েরা কপালের যেখানে টিপ পরে থাকে মেডিটেশন বা যোগাসন অনুযায়ী সেই স্থানকে বলা হয় অজ্ঞান চক্র। এ স্থানটি থার্ড আইয়ের একটি বিশেষ অংশ। তাই এই স্থানে টিপ পরলে পাওয়া যায় বিশেষ উপকারিতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা নিয়মিত মাথা ব্যথায় ভুগেন তারা অবশ্যই নিয়মিত টিপ পরার অভ্যাস করতে পারেন। কপালের মাঝখানের এক বিশেষ চক্র হলো অজ্ঞান চক্র। এই স্থানে টিপ পরলে হালকা যে চাপ অনুভূত হয় তা এই চক্রকে দমন করতে কার্যকরী। তাই মানসিক প্রশান্তি কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নিয়মিত টিপ পরার অভ্যাস করতে পারেন। সাজের এই টিপ নিয়মিত পরার অভ্যাসে মেয়েদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক সমস্যা দূর হয়।

গবেষকরা টিপ পরার আরও অনেকগুলো উপকারিতা খুঁজে পেয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, যারা নিয়মিত টিপ পরে, তাদের মুখের পেশি মজবুত হয়। শুধু তাই নয়, নিয়মিত টিপ পরার কারণে মুখের বলিরেখাও দেরিতে পড়ে। টিপ পরলে স্নায়ু উত্তেজিত হয়। এর ফলে কানের পেশি মজবুত হয় ও শ্রবণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

আজকাল কম বেশি সবাই মানসিক চাপ অনুভব করে থাকেন। নিয়মিত টিপ পরার অভ্যাসে মানসিক চাপ দূর হতে পারে অনেকটাই। এমনকী সারাদিন ধরে সতেজ থাকতেও কপালে একটি টিপ পরতেই পারেন। যে সব নারী অনিন্দ্রায় ভুগে থাকেন তারা নিয়মিত টিপ পরতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে অনিদ্রার সমস্যা দূর হবে। বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রও একই কথা বলে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, লাল ও নীল রঙের টিপ পরার অভ্যাসে দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ও মন ভালো থাকার প্রবণতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

হাঙ্গামা/ধ্রুব চৌধুরী
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url