যাদের কোনো দেশ নেই - (২য় পর্ব) : ইমিগ্রেশনে জানলেন কোনো দেশ নেই মিখাইলের

স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা মানুষের জাতীয়তা থাকে। দেশ থাকে, দেশের পরিচয় থাকে। হয়তো এদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অনেকের বাড়ি-ঘড় থাকেনা। থাকেনা মাথা গোজার একটু ঠাই। তবে তাদের দেশ থাকে। কিন্তু এই প্রতিবেদনে এমন কিছু মানুষ কিংবা জাতির কথা উঠে আসবে, তাদের সত্যি বলতে কোনো দেশ নেই। নেই জাতীয়তা। 

কোন দেশের নাগরিক, কোনটি তোমার দেশ? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই অন্তত ৮ কোটি ২৪ লাখ মানুষের। বিভিন্ন রকমের সংকট আর দুর্দশায় ভরা দেশবিহীন এই মানুষগুলোর জীবন। এদেরমধ্যে রোহিঙ্গাদের মতো অনেক শরণার্থী রয়েছেন। যারা বিভিন্ন দেশে পরিচয়বিহীন ভাবে আটকে আছেন। এদের অনেককেই গ্রহণ করেনি জন্মভূমি কিংবা আবাসভূমি। এই দেশ পরিচয়হীন মানুষদের কাহিনী নিয়েই হাঙ্গামা২৪-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘যাদের কোনো দেশ নেই’। আজ প্রকাশিত হলো এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব।
ইমিগ্রেশনে জানলেন কোনো দেশ নেই মিখাইলের
ইমিগ্রেশনে জানলেন কোনো দেশ নেই মিখাইলের 

ইমিগ্রেশনে জানলেন কোনো দেশ নেই মিখাইলের 


অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত পলিনেশিয়া। এটি মূলত বৃহত্তর ওশেনিয়া অঞ্চলের একটি উপ অঞ্চল। এই অঞ্চল প্রায় ১০০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এরমধ্যে রয়েছে অনেকগুলো দ্বীপরাষ্ট্রও। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে সামোয়া। সেখানেই অবসর সময়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন মিখাইল সেবাস্তিয়ান। দ্বীপের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে অবসর কাটাবেন, সারবেন সমুদ্রের নীল জলে স্নান; এমন বাসনাই ছিলো তার। ছোট্ট এই দ্বীপদেশে সময় কাটাবেন টানা চারদিন। এমনই ছিলো তার ভ্রমন পরিকল্পনা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ছুটলেন বিমান বন্দরে। বিমানে চড়ার আগে ইমিগ্রেশন, কাস্টমসহ সব ধাপ পার করেন মিখাইল। তখনো কেউই তাকে কিছুই বলেনি। তারমতো ছুটি কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেকেই তার সাথে বিমানে উঠেছিলেন। সবাইই ঠিকঠাকভাবে সামোয়ায় পৌছলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্রমনের সব ইচ্ছেই পুরণ করলেন মিখাইল। কিন্তু ফেরার সময়ই তার এই চার দিনের ভ্রমণ যেনো দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠলো।

ফেরার জন্য যে টিকিট কেটেছিলেন তা নিয়ে বিমান বন্দরে পৌঁছার পরই বাধলো গন্ডগোল। সেখানে মিখাইলকে আটকে দিলেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। তারা জানালেন মিখাইলের কোনো দেশই নেই! এমন তথ্য শুনে মিখাইল যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। এরপর টানা তিনবছর তাকে কাটাতে হয়েছে দেশছাড়া।

তার গল্পের শুরুটা ছিলো এমন। মিখাইল সেবাস্তিয়ান মূলত ১৯৭৩ সালে আজারবাইজানে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের পর থেকে পরিবার নিয়ে এ দেশে সুখেই ছিলেন। এই দেশটি তখন ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশ। তাদের সুখের পরিবারে বিপদ আসে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। তখন আজারবাইজানের অনেক মানুষ নাগরিকত্ব হারায়। সেই দলে ছিলেন মিখাইলও।

মিখাইলের পূর্বপুরুষ যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী ছিলেন। তাই তার ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের টান ছিলো। তখন আজারবাইজান প্রশাসন বললো, তুমি আমেরিকান। আর আমেরিকা বললো, তুমি আজারবাইজানের, আমাদের কেউ নও তুমি! তার কাছে কোনো দেশেরই পাসপোর্ট ছিলো না। সেক্ষেত্রে আর্মেনিয়া বললো, আমাদের দেশে থাকার মতো কোনো পরিচয় নেই তোমার। তাই তিন বছর দেশ ছাড়াই থাকতে হলো মিখাইলকে।

অনেকদিন দেশবিহিনভাবে উদ্ভাস্তু শিবিরে কাটিয়ে অনেক দেন-দরবার করে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভ্রমণ ভিসা জোগাড় করলেন। অনুমতি পত্রও বলা যায় একে। কারণ তিনি এটি অ্যাসাইলাম চেয়ে জোগাড় করেছিলেন। যদিও ১৯৯৬ সালে সেই অনুমতি পত্র বাতিল করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর মিখাইলকে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে দেশটির প্রশাসন। কিন্তু মিখাইল কোথায় যাবে তা কেউ বলতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্র তার বিষয়টা জেনেও তাকে ফেরত যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। ততদিনে অকেজো হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাসপোর্ট। এদিকে দেশ হারানো মিখাইলের দুর্দিন চরম আকার ধারণ করে। এমনকি তখন তার দিন কাটে জেল খেটে ও আদালতে শুনানি দিয়ে। 

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা মিখাইলকে অন্য দেশে পাঠানোর চেষ্টা শুরু করে। এতে কোনো লাভ হয়নি। তাকে কোনো দেশই গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এতো টানা হেচড়ার পর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা দয়া দেখিয়ে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে বাইরে বসবাসের অনুমতি দেয়। তবে তাকে বেধে দেয়া হয় শর্ত। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের শর্ত ছিলো-  তিন মাস পরপর এসে ইমিগ্রেশন অফিসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে মিখাইলকে।

কাজের জন্য তাকে বিশেষ অনুমতিও দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ভ্রমণ করতে প্রতি বছরই ইমিগ্রেশনের হাতে-পায়ে ধরে অনুমতি নিতে হতো মিখাইলকে। যদিও এর মধ্যে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ব্রিটেন, জাপান, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, তুর্কেমিনিস্তান ছাড়াও অন্তত আরও ছয়টি দেশে তিনি ভ্রমণ ভিসার আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছেন। এই দেশগুলো তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয় নি।

এই দেশগুলোর কেউ তাকে পাসপোর্টও দিতে চাইল না। এরা সবাই বললো, তুমি আমার দেশের কেউ না। পুরো পৃথিবীই যেনো তার জন্য কারাগার হয়ে উঠলো। এভাবেই কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। ২০১১ সালে মিখাইল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আর্জি করলেন এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে। তিনি অন্তত কোথাও বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে সামোয়াতে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

সেখানে গিয়েই ভুলটা করেন মিখাইল। সামওয়া থেকে ফেরার সময়ই যুক্তরাষ্ট্র তাকে অস্বীকার করে। এরপর অই দ্বীপে পুরো চার মাস আটকে ছিলেন মিখাইল। দেশ-পরিচয় বিহীন বলে কেউ তাকে কোনো কাজ দেয়নি সেখানে। তাই এককথায় ভিক্ষে করে খাবার খেতে হয়েছে তাকে। তার এমন দুর্দশার খবর সংবাদমাধ্যমে খুব বড় করে প্রচার হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করে। এতোদিনে তিনি চাকরি হারিয়েছেন। যে বাসাটি ভাড়া নিয়ে থাকতেন, সেটিও হারিয়েছেন। তার বন্ধুরাও সেখানে নেই। সব হারিয়ে মিখাইল সেবাস্তিয়ান দিশেহারা হয়ে পড়েন।

মিখাইল একা নন, তার মতো কয়েক হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন যাদের কোনো দেশ পরিচয় নেই। এরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও মূলত তারা কোনো দেশেরই নাগরিক নন।

হাঙ্গামা/ধ্রুব
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url