Lata Mangeshkar : হেমা যেভাবে হলেন কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর
হেমা যেভাবে হলেন কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর |
হেমা যেভাবে হলেন কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর
কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণে গোটা ভারতবর্ষ শোকে মুহ্যমান। সঙ্গীতপ্রিয়দের চোখে জল। যেন রাজ্যের সব আঁধার নেমে এসেছে সবার ঘরে। ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’খ্যাত লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোক ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে ছুঁয়ে গেছে দুনিয়ার তাবৎ সঙ্গীতপ্রেমীদের। শীতের ভোর এমন দুঃসংবাদ বয়ে আনবে কে জানত!
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গত ২৮ জানুয়ারি ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসও নিতে পারছিলেন। ডাক্তাররা বলছিলেন, তার শারীরিক অবস্থা ক্রমেই ভালোর দিকে। কিন্তু ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে আবার জটিলতা শুরু। এবার কাউকে আর কিছুটি করার সুযোগ না দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
শতাব্দী, দেশ, সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যিনি সুরে, লয়ে প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন সঙ্গীত পিয়াসুদের, সেই কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর রোববার ভোরে যাত্রা করলেন অনন্তলোকের পথে।
একনজরে কিংবদন্তির অনবদ্য জীবন
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বীননাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘরে জন্ম নেন লতা মঙ্গেশকর। পণ্ডিত দ্বীননাথ নিজেও ছিলেন সঙ্গীত আচার্য। সঙ্গীত আর নাটক - দু ক্ষেত্রেই ছিল তার সদর্ভ বিচরণ। ‘ভাউবন্ধন’ নামের এক নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র লতিকাকে খুব মনে ধরেছিল দ্বীননাথ-সেবন্তী দম্পতীর। তাই সন্তানের নাম হেমা থেকে বদলে রাখা হলো লতা।
ছোট্ট লতার গান বা অভিনয়-দুটোর হাতে খড়ি হয়েছিল বাবা দ্বীননাথের কাছে। পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অংশগ্রহণ করতেন লতা। পিতার ছায়া খুব বেশিদিন থাকেনি মঙ্গেশকর পরিবারের উপর। ১৯৪২ সালে লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সী লতার উপর।
পারিবারিক বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাকে গান আর অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে শেখালেন। মারাঠী চলচ্চিত্রে গাওয়া তার গান ‘খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ চলচ্চিত্রের ফাইনাল কাট থেকে বাদ পড়ে গেল। তবু দমে যাননি লতা। মাস্টার বিনায়ক তার চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’ এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য ছোট্ট একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। এ চলচ্চিত্রে দাদা চান্দেকারের রচনা করা গান ‘নাটালি চৈত্রাচি নাভালাল’ এ কন্ঠ দেন তিনি।
তখনও চলছে তার জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ। চলচ্চিত্রের জীবনকে কখনো আপন করে নিতে পারেননি লতা। একদিন কাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন। মায়ের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এই কৃত্রিম অভিনয়ের জগত আর ভালো লাগে না তার। কিন্তু কিছু করার নেই, পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। বসন্ত যুগলকরের ‘আপ কি সেবা ম্যায়’ চলচ্চিত্রে ‘পা লাগো কার জোরি’ গানটি তার প্রথম হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে গাওয়া গান। মাস্টার বিনায়কের মৃত্যুর পর সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার হন লতার গুরু।
৮৪তম জন্মদিনে তিনি বলেছিলেন, গুলাম হায়দার তার জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন। গুলাম হায়দারের হাত ধরে তার জীবনে সুযোগ এল ‘মজবুর’ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’ গানটি গাওয়ার। এই এক গানেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নতুন এই গায়িকাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। জীবনের প্রথম বড় ধরনের হিট নিয়ে আসে ‘মহল’ (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। এ গানে ঠোঁট মেলালেন মধুবালা।
সেই তো সবে শুরু। এরপর লতাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ একের পর এক গান উপহার দিয়েই গেলেন। ষাটের দশকে উপহার দিলেন ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’ এর মতো এখনও পর্যন্ত তুমুলভাবে বিখ্যাত সব গান। লতার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। লতা মঙ্গেশকর একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েই চলেছেন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে লতা গাইলেন ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’; যা উতলা করে দিয়েছিলো শ্রোতাদের মন ৷ ১৯৫৫ সালে ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ দুলিয়েছিলো শ্রোতা হৃদয়, ৫৭-তে ‘আজারে পরদেশী’ ডাক দিল দুনিয়ার সঙ্গীত রসিকদের।
খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গেলেন কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর। ক্রমাগত সুপার ডুপার হিট বহু গানের দৌলতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মাথায় তুলে নিলো লতাকে। সঙ্গীত পরিচালকদেরও নয়নের মণি হয়ে উঠলেন তিনি। গানের ভাব অনুযায়ী গায়কীকে তৈরি করে নেওয়ার আশ্চর্য দক্ষতা ছিল লতার। একই ছবিতে তিনজন নায়িকার কণ্ঠে গান গেয়েছেন লতা, গাইবার ভঙ্গি প্রতিক্ষেত্রেই পাল্টে নিয়েছেন তিনি।
নার্গিসের মতো প্রায় প্রৌঢ় নায়িকার কণ্ঠে যিনি মানানসই, সেই লতার কণ্ঠ অবলীলায় মিলে যায় ‘ববি’র কিশোরী ডিম্পলের সঙ্গে। শিশুকণ্ঠের গান, বিরহের বা উচ্ছ্বাসের গান, শিশুকে ঘুম পাড়ানো মায়ের গান, প্রেমের গান, ভক্তিমূলক গান যাই হোক না কেন সিকোয়েন্সের সব পুরোপুরি মিটিয়ে প্রার্থিত ভাবটি অতি নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন কিন্নরকণ্ঠী লতা।
১৯৬৩ সাল; ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জওহরলাল নেহরু। সত্তরের দশকে শত শত গান সৃষ্টির সাথেই কনসার্ট করেছেন দেশে-বিদেশে, তাদের অনেকগুলো আবার চ্যারিটিও। থেমে থাকেনি সময়, থেমে থাকেননি লতা। তার এত এত সৃষ্টির ফলে অনায়াসে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বোচ্চ সংখ্যার গান রেকর্ডকারী হিসেবে তার নাম আসে। পরে অবশ্য তার এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন নিজেরই ছোট বোন আশা ভোঁসলে। মোট ৩৬টি ভাষায় রচিত তাঁর এই গানগুলোর অনেকগুলো ভাষা তিনি আসলে জানতেনই না। তার মধ্যে বাংলা গানও আছে।
কয়েক দশক ধরে লতা শুধু যে সঙ্গীতের সাধনা করে গেছেন তাই নয়, ধীরে ধীরে এক অসাধারণ সঙ্গীত শিল্পী থেকে নিজেকে করে তুলেছেন কিংবদন্তি। সঙ্গীত পরিচালকদের একাধিক প্রজন্মের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করে গেছেন তিনি। আর তাই নতুন শতাব্দীতে এসেও তিনি একই রকম প্রাসঙ্গিক। তার গুণগান করার জন্য নওশাদ আলী থেকে এ আর রহমান পর্যন্ত সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকেন। মহম্মদ রফি, হেমন্তকুমার, কিশােরকুমার, শামশাদ বেগম, আশা ভোঁসলে, মুকেশ, তালাত মেহমুদ, মান্না দে-র মতাে সহশিল্পীরাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন।
তিনটি জাতীয় পুরস্কার, ১৫টি বিএফসে পুরস্কার, ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ছাড়াও পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফলকে পুরস্কারের পর ২০০১ সালে তিনি অর্জন করেন ভারতরত্ন সম্মান। ২০০৭ সালে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ নাগরিক সম্মান ‘লিজিওন অফ অনার’এ ও ভূষিত হন তিনি। এত সব অর্জনের পরও লতা মঙ্গেশকর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি মনে করতে পারেন না কোনটি তার জীবনের সেরা গান, সেরা মুহূর্ত। গানটাই যেন তার জীবনের এক অন্য যাত্রাপথ। তিনি বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার ছিল, আরও কিছু কাজ করা বাকি ছিল তার। সেই বাকি কাজগুলো তার অসমাপ্তই রয়ে গেল।
সফলতার শীর্ষে পৌঁছালেও লতা মঙ্গেশকর ব্যক্তিগত জীবনে একাই থেকে গেলেন। বিয়ে করেননি তিনি। কেন সুর সাধনার পাশাপাশি সংসার ধর্মে মন দিলেন না তিনি? কেনই বা চিরকাল অবিবাহিতই রয়ে গেলেন?
শোনা যায়, লতা মঙ্গেশকর একসময় কাউকে ভালোবেসে ছিলেন, কিন্তু তার সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি। প্রেমে সফল হননি বলেই লতা চির অবিবাহিত থেকে গিয়েছেন, এমনটাই শোনা যায়। দুঙ্গরপুরের রাজ ঘরানার মহারাজ রাজ সিংয়ের প্রেমে পরেছিলেন লতা। ইনি সম্পর্কে লতার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। গায়িকার সেই প্রেম পরিণতি পায় নি। রাজ সিং নাকি বাবা-মাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কোনো সাধারণ ঘরের মেয়েকে তিনি রাজবংশের বউ করে আনবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা বজায় রেখেছিলেন রাজ সিং। তিনিও কখনও বিয়েই করেন নি।
লতার থেকে ৬ বছরের বড় রাজ সিং আদর করে লতাকে মিট্টু বলে ডাকতেন আর পকেটে সবসময় একটি রেকর্ডার নিয়ে ঘুরতেন তিনি, সেই রেকর্ডারের মধ্যে রেকর্ড করা থাকতো লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত কিছু গান। ২০০৯ সালে প্রয়াত হন তিনি। তবে রাজ সিং ব্যতীত লতার দীর্ঘ জীবনে কখনও আর কারও সঙ্গে নাম জড়ায়নি গায়িকার।
তবে লতা মঙ্গেশকরের বোন মিনা খাদিকারের লেখা জীবনীগ্রন্থে লতা সম্পর্কে লেখা হয়েছে একটি মজার তথ্য। এক গীতিকবির ওপর খেপেছিলেন তিনি। নাকশাব জার্চাওয়ি নামের এক গীতিকবিকে কেটে টুকরো টুকরো করতে চেয়েছিলেন তিনি। সে প্রসঙ্গে লতা বলেছেন, ‘ঠিক তেমন নয়। কিন্তু তাঁর ওপর ভীষণ রাগ করেছিলাম। সামনাসামনি ভীষণ বকাও দিয়েছিলাম। তিনি নিজের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে গুজব রটিয়েছিলেন। বেচারা মারা গেছেন। তখন আমি অনেক রগচটা ছিলাম। আমার সামনে কেউ উল্টাপাল্টা করতে ভয় পেত।’
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে লতা গুরুত্ব দিয়েছিলেন নিজ পরিবারকে। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের সকল সদস্যের দায়িত্ব তার ঘাড়ে চেপেছিল। তাই এমন পরিস্থিতিতে বিয়ের চিন্তা করলে সবকিছু বিফলে যেত। এমনকি সেই সময়ে বিয়েকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেও পারেননি তিনি। তাই ওই সময় সঙ্গীতকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন বেছে নেন লতা মঙ্গেশকর।
হাঙ্গামা/প্রিয়াঙ্কা