মডেলের ছদ্মবেশে সিরিয়াল কিলার; কে এই হেলাল

মডেলের ছদ্মবেশে সিরিয়াল কিলার; কে এই হেলাল
মডেলের ছদ্মবেশে সিরিয়াল কিলার; কে এই হেলাল

মডেলের ছদ্মবেশে সিরিয়াল কিলার; কে এই হেলাল


মডেল হেলাল হেসেন, সেলিম হোসেন, বাউল সেলিম, দুর্র্ধষ হেলাল, হাত লুলা হেলাল। এরা কেউই ভিন্ন ব্যক্তি নন। এ নামগুলো একজনেরই। এতোসব পরিচয়ের মাঝে তার আসল পরিচয় তিনি একজন ‘সিরিয়াল কিলার’। নামের মধ্যে মডেল কিংবা বাউল থাকলেও এ দুটোর কোনোটাই তার পেশা নয়। বরং এগুলো তার ছদ্মবেশী রুপ। এমন তথ্যই জানিয়েছেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

হেলাল হেসেনকে মূলত কিশোর পলাশের গাওয়া ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’ গানের ছয় বছর আগের একটি ভিডিওতে বাউল রুপে দেখা যায়। সেখান থেকেই তার নামের সঙ্গে ‘মডেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। হেলার প্রায় ৭ বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরারি জীবনযাপন করছে। গত ৪ বছর ধরে এক নারীর সঙ্গে বসবাস করছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনের পাশে। বিগত ৭ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনে বাউল গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত হেলাল।

১৩ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। জানা যায় ১২ জানুয়ারি (বুধবার) রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই ভয়ঙ্কর খুনিকে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “সেলিম ওরফে হেলাল বিভিন্ন মাজার এবং রেলস্টেশনে থাকতেন। যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, সেলিম অন্তত তিনটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। বাউলের বেশভূষা নিয়ে বহু বছর ধরে সে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলো। হেলাল উত্তরবঙ্গের একজন ভয়ঙ্কর খুনি। তার বিরুদ্ধে ওই এলাকায় তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে।”

উত্তরবঙ্গের একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হেলাল হোসেন ওরফে সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

র‍্যাব জানায়, গানের মডেলের আড়ালে হেলাল উত্তরবঙ্গের একজন ভয়ঙ্কর খুনি। তার বিরুদ্ধে ওই এলাকায় তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। ‘ভাঙা তরী ছেঁড়া পাল’ গানের মডেল হয়ে বেশি পরিচিতি পান তিনি। গানের বাউল ওরফে মডেল সেলিম ওরফে খুনি হেলাল হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তার।

জানা যায়, সিরিয়াল কিলার হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম (বাউল সেলিম) শিক্ষাজীবনে অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন। এরপর তার এলাকায় একটি মুদির দোকানে কাজ করতেন। ১৯৯৭ সালে বিষু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মাত্র ২১ বছর বয়সে অপরাধ জগতে পা রাখেন হেলাল। এরপর থেকে এলাকায় বিভিন্ন মারামারিসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে দুর্র্ধষ হেলাল নামে পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়াও ২০০১ সালের চাঞ্চল্যকর বিদ্যুৎ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম খুনি এই হেলাল। এ হত্যাকাণ্ডে তার যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে আদালত। 

র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম জানায়, ২০০১ সালে বগুড়ার চাঞ্চল্যকর মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎ হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সে আরও ২টি হত্যা মামলার আসামি। ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা এবং ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলার আসামি বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে হেলাল। 

২০০০ সালে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষের সংঘর্ষ ঘটে। তখন প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হেলালের বাম হাতে মারাত্মক জখম হয়। এতে তার বাম হাত পঙ্গু হয়ে যায়। এ ঘটনার পর সে হাত লুলা হেলাল নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করে। ২০০৬ সালে বগুড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রবিউল নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে চার্জশিটভুক্ত আসামি সেলিম ওরফে হেলাল।

এদিকে, ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় হেলালের বিরুদ্ধে একটি চুরির মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলায় ২০১৫ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন ২০০১ সালের বিদ্যুৎ হত্যা মামলার বিচারকাজ চলমান রয়েছিলো। ২০১৫ সালের যেদিন ওই চুরির মামলায় সে জামিনে মুক্তি পায়, ঠিক ঐ একই দিনে বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায় জানতে পেরে কৌশলে এলাকা ত্যাগ করে ফেরারি হয়ে যায় হেলাল। ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও মামলা দায়ের হয়েছিলো বলে জানা যায়।

এই কুখ্যাত হেলাল তার ফেরারি জীবনের প্রথমে বগুড়া থেকে পালিয়ে ট্রেনযোগে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে যায় এবং সেখানকার আমানত শাহ মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশকিছুদিন অবস্থান করে। সেখান থেকে সিলেটের শাহজালাল মাজারে চলে যায় হেলাল। সিলেটে গিয়ে ছদ্মবেশ নিয়ে আরো কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশ ধারন করে অবস্থান করত। সে সর্বশেষ কিশোরগঞ্জ ভৈরব রেলস্টেশনে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন রেখে সেলিম ফকির নাম ধারণ করে অবস্থান করছিলো।

যেভাবো ধরা পড়লো এই সিরিয়াল কিলার
 
র‍্যাবের ভাষ্যমতে, আনুমানিক ৫ বছর আগে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে ছদ্মবেশে বাউল গান গাচ্ছিল। তখন জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশ এর ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’ গানের শুটিং চলছিলো। তখন শুটিংয়ের একজন ব্যক্তির নজরে পড়ের বাউলবেশী হেলাল। তাকে মিউজিক ভিডিওতে মডেলিংয়ের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় এবং তার কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়। 

আনুমানিক গত ৬ মাস আগে জনৈক ব্যক্তি র‍্যাবকে তথ্য দেয়। সে র‍্যাবের জানায়, ইউটিউবে প্রচারিত ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল গানের বাউল চরিত্রের মডেলটি সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র‍্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে র‍্যাব নিশ্চিত হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয় কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার হেলাল ওরফে সেলিমকে।

হাঙ্গামা/সানজানা
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url