বাস্তবের মহানায়ক খসরু আজ জীবনযুদ্ধে অসহায়

বাস্তবের মহানায়ক খসরু
বাস্তবের মহানায়ক খসরু

বাস্তবের মহানায়ক খসরু জীবনযুদ্ধে অসহায় 


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমাটিই ছিলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। ছবির নাম ‘ওরা ১১ জন’। এ কালজয়ী ছবিতে যুদ্ধের দৃশ্য দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যিকারের গোলাবারুদ। এমনকি এতে অভিনয় করেছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের কথা আসলেই পাঠকের চোখে ভেসে উঠে এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা মুক্তিযোদ্ধা খসরুর মুখ। কামরুল আলম খান খসরু শুধু বড় পর্দার নায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাস্তবের মহা নায়ক। কালের যাত্রার এই দিশারীকে নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এই প্রতিবেদন।

ঢাকার খান বাহাদুর নূরুল হক খানের দৌহিত্র কামরুল আলম খান খসরু বাংলার ইতিহাসে এক দুরন্ত নাম। চাচাত ভাই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরাজুল আলম খানের (দাদা ভাই) প্রেরণায় ষাটের দশকের শুরুতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া খসরু ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফাকে পাশ কাটিয়ে তা স্বাধীনতার ১ দফায় পরিণত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের আন্দোলন-সংগ্রামের নেপথ্য নায়কের ভূমিকায় ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তীকালে খসরু ছিলেন মুজিব-আদর্শের একজন দেশপ্রেমিক। তিনি তৎকালিন সময়ে ছাত্রলীগের মিছিল-সভা-সমাবেশে ছিলেন অতন্দ্রপ্র্রহরী। কামরুল আলম খান খসরু ও মোস্তফা মহসীন মন্টু (খসরু-মন্টু) জুটি হিসেবে পাকিস্তান সরকারের পাণ্ডাবাহিনী এনএসএফের আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রাস পাঁচপাত্তু ও খোকার এনএসএফ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবসময় আতঙ্কে থাকতো। রমনার রেসকোর্সে পাঁচপাত্তু ও খোকার বিকৃত লাশ পাওয়ার খবরে সাধারণ ছাত্রসমাজের মধ্যেও স্বস্তি ফিরে আসে এবং এনএসএফ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকিস্তানের সামরিক আদালত খসরু, মন্টু ও সেলিমকে (মন্টুর ভাই) ১৪ বছর কারাদণ্ড দিয়ে হুলিয়া জারি করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু তাদের দণ্ড মওকুফ করার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। যদিও তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারেনি পাক-পুলিশ বাহিনী।

একাত্তরের উত্তাল মুহূর্তে নিউমাকের্ট, বায়তুল মোকাররম ও নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস ক্লাবের অস্ত্র লুট এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে হামলার কথা উল্লেখ করে খসরু এর আগে এক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “আমার সঙ্গে এ সময় ইনু (হাসানুল হক ইনু) জুডো মণি, বাবু ও রেজা শাজাহান ছিল।”

একাত্তরের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে কামরুল আলম খান খসরু একটি পয়েন্ট ২২ রাইফেল দিয়ে শূন্যে ফায়ার করে গান স্যালুট প্রদান করে ছাত্রলীগের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেন। নিউক্লিয়াসের রূপকার সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে খসরু একটি দুঃসাধ্যও সাধন করেছিলেন সরকারি হুলিয়ার মুখেও। তিনি নীলক্ষেত থেকে দর্জির দোকান খুলিয়ে প্রথম তৈরি জাতীয় পতাকার কাপড় সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। 

ঢাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করার পথ প্রশস্ত হয়েছিল কামরুল আলম খান খসরুর মতো দুই-চারজন বীর সাহসী যোদ্ধার কারণেই। ঢাকাকে শত্রুমুক্ত করার সেই যুদ্ধজয়ের কাহিনীজুড়ে রয়েছে খসরুর বীরত্বগাথা। জীবন-যৌবনের উত্তাল দিনগুলোতেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের ময়দানে কাঁধে স্টেনগান চড়িয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। সশস্ত্র জীবন শেষে যুদ্ধের বীরত্বগাথাকে অমরত্ব দেওয়ার জন্য নির্মাণ করেন ‘সংগ্রাম’, ‘ওরা ১১ জন’সহ আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। খসরু নিজেই নায়কের ভূমিকায় রূপদান করে দৃশ্যত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকেই তুলে ধরেন ইতিহাসের পাতায়। দেশ শত্রুমুক্ত হলেও স্বাধীনতায় খুব একটা গা ভাসানোর সুযোগ হয়নি। আপন দেশে নিজেদের মাঝে রক্তারক্তি, হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে নিজেকে আড়ালের চেষ্টাই করেছেন তিনি।

এখন অনেকটা নীরবে নিভৃতে একাকী দিনযাপন করছেন বাস্তবের মহানায়ক কামরুল আলম খান খসরু। বাইপাস অপারেশনে শারীরিক বিপর্যয়ে এখন শয্যাসায়ী। বীর মুক্তিযোদ্ধা খসরু যেন জীবনের যুদ্ধে আজ বড় অসহায়। কেউ তার খোঁজ রাখে না। তার কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের অমোঘ মন্ত্র হিসেবে প্রেরণা জোগালেও ইতিহাসের বিচারে খসরু সবার অলক্ষ্যে থেকে গেছেন। তার পরিচালিত বাহিনীর অনেকে স্বাধীনতার বীরউত্তম, বীরবিক্রম বা বীরপ্রতীকের রাষ্ট্রীয় ভূষণ পেলেও খসরুর চোখে বয়ে যায় একনদী জল। কামরুল আলম খান খসরু এখন সবার অগোচরে। দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। যৌবনের তারুণ্যে উচ্ছ্বসিত উচ্ছল অকুতোভয় মুজিবসৈনিককে যেন দেখার কেউ নেই।

এই সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা গণমাধ্যমে খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “যেহেতু আমার স্বীকৃতি আমার দেশ দিল না, সেখানে আমি দাবি করছি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও এ-দেশি তাদের দোসর জামায়াত-শিবিরসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে, তারাই বলুক খসরু তাদের কয় নম্বর শত্রু  ছিল? তারা বলুক, ওদের শত্রু  হিসেবে আমার বীরউত্তমের স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে কি না”। এ প্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে কামরুল আলম খান খসরু নিঃসংকোচে বলেন, “দাদাভাই (সিরাজুল আলম খান) জাসদ করেছেন বলেই শুধু আমি নই, হাজার হাজার নেতা-কর্মী মুক্তিযোদ্ধার সনদ লাভ করেননি। আমি কিন্তু জাসদ করিনি, বরং ভুয়াদেরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।”

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম আছে কি না প্রসঙ্গে খসরু বলেছিলেন, “২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম দেখেছি। আর গত বছর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটা সার্টিফিকেট আমার নামে পাঠিয়েছে” এ কথা উচ্চারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়া বীর খসরু এরপর যে কথাটি জানিয়ে দিলেন তা আরও বেদনাদায়ক।

“১৯৭২ সালের ৩১ মে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের ২২ নম্বরের (পুরনো) একটি সরকারি বাড়ি দিয়েছিলেন। যুদ্ধজয়ের পর সেখানেই আমরা উঠেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে ওই বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করেন। এটাই হলো আমার নিয়তি। হ্যাঁ, এ জন্যই তো মুক্তিযুদ্ধ করে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করেছিলাম- তাই না?”

হাঙ্গামা ২৪
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url