সালতামামি : যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব
সালতামামি ২০২১ |
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব
সব কিছু নতুনভাবে শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। এভাবেই এক এক করে বছরগুলো পুরনো বা পূর্ববর্তী হয়ে যায়। ২০২১ সালও চলে যাচ্ছে সে তালিকায়। আর কদিন পরেই বিশ্ব নতুনভাবে বরণ করবে নতুন বছর ২০২২ সালকে। তবে পুরোনো দিনগুলো নতুন অনেক বিষয়ের সাক্ষী হয়ে থাকে। ২০২১ এর বিশ্বকে চমকে দেয়া তেমনই কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিয়ে আমাদের আজকের এ প্রতিবেদন।
হাজার বছরের পুরোনো আংটি
২০২১ সালের আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম আবিষ্কার হচ্ছে এই আংটি। যা ইজরায়েলের পুরাকীর্তি বিভাগ গত নভেম্বরে খুজে পেয়েছে। ইয়াভনে শহরের একটি পরিত্যক্ত পানশালা থেকে এটি আবিষ্কার করা হয়। দুর্মূল্যের সোনার এ আংটিতে বসানো রয়েছে একটি বেগুনি রঙের বিস্ময়কর পাথর। অবাক করা ব্যপার হলো এই আংটির বয়স। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এর বয়স কয়েক হাজার বছর। ধারণা করা হচ্ছে, তৃতীয় থেকে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি বাইজেন্টাইন শাসন আমলের কোনো এক ধনী ব্যক্তি মূল্যবান এই আংটির মালিক ছিলেন। খুব সম্ভবত ওই ব্যক্তি সুরাপান করতে গিয়ে নেশার ঘোরে আংটি ফেলে আসেন পানশালায়।
যিশুখ্রিস্টের হারানো চিত্রকর্ম
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
ইতালির একটি গ্রামের দেওয়ালে টানানো ছিল একটি চিত্রকর্ম। জন্মের পর শিশু যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে দেখা করতে আসা তিন জ্ঞানী ব্যক্তির প্রথম সাক্ষাৎকারের বিষয়টিই ছিলে সে চিত্রের বিষয়বস্তু। এমন একটি ‘পবিত্র’ চিত্রকর্ম সে গ্রামে থাকলেও কেউ জানতেন না এই ছবি কে বা কবে একেছিলেন। অবশ্য কেউ তার খোঁজ নেয়ার আগ্রহও দেখাননি। ২০১৬ সালে এই চিত্রকর্মটি দেয়াল থেকে খসে মেঝেতে পড়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছবিটি। এরপর ছবিটি মেরামত করতে গিয়ে সামনে আসে অবাক করা তথ্য। জানা যায়, দুর্মূল্যের এই ছবিটি একেছেন সপ্তদশ শতকের শিল্পী রেমব্রান্ট। ধারণা করা হয়, এটি আঁকা হয়েছিল ১৬৩২-১৬৩৩ সালের দিকে। কয়েক মাস আগে ইতালির হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সে হিসেবে হারিয়ে যাওয়া এ তথ্যবহুল চিত্রকর্মটিও ২০২১ সালের অন্যতম আবিষ্কার।
আস্ত একটি শহর
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
মিসরে ঘটা এ আবিষ্কারটি বছরের সেরা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হিসেবে ধরা হয়েছে। এখানে ছোট খাটো কোনো বস্তু নয়, আস্ত একটি নগরীই খুঁজে পাওয়া গেছে। অনুমান করা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত নগরগুলোর ভেতর এটি মিশরের সবচেয়ে বড় প্রাচীন নগর। এর আনুমানিক বয়স ৩ হাজার বছরেরও বেশি। মরুভূমির বালির মাত্র ১০ ফিট গভীরে আস্ত এ শহরটি পুরো ডুবন্ত অবস্থায় ছিলো। ২০২০ সালে মিশরের লুক্সর শহরে প্রথম হারানো এই নগরের সন্ধান মেলে।
শহরের সাথে খুজে পাওয়া গেছে এই শহরে একটি সমাধিস্থল। সেখান থেকে বহু প্রাচীন কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। মিলেছে প্রাচীন বাসনপত্র, জাতাকল, কাঁচ ও কাপড় বোনার যন্ত্র, গয়না ইত্যাদি। সেখানে জিনিসপত্রগুলো এমনভাবে রাখা আছে যে দেখলে মনে হতে পারে সেগুলো সদ্যই সেখানে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হয়, তৃতীয় আমেনহোটেপের সময় এই নগরী বেশ জমকালো ছিল। মিশরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেতসি ব্রায়ান জানিয়েছেন, তুতেনখামেনের সমাধির পর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এটি।
বিশ্বের প্রাচীনতম গুহাচিত্র
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
এ বছর ৪৫ হাজার বছরেও বেশি পুরোনো এক গুহাচিত্র আবিষ্কার করা হয়েছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে প্রাচীন গুহাটি আবিষ্কৃত হয়। সেই গুহার দেওয়ালেই আঁকা ছিল ৪৫ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো এ চিত্রকর্মটি। গুহাচিত্রে শূকরের মতো তিনটি প্রাণীকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুটি প্রাণী লড়াই করছে আর একটি প্রাণী সেই লড়াই দেখছে। লালচে রঙের পাথর বা অন্য কিছু দিয়ে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। এর আগেও এই অঞ্চলে আরও কিছু গুহাচিত্রের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ৪৩ হাজার ৯০০ বছরের পুরোনো। সেটি একটি শিকারের ছবি।
বলিদানের স্থানে সোনার মুখোশ
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
চলতি বছরের জুন মাসে চিনের স্যানশিংদুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে প্রায় ৫০০টি বলিদানের গর্ত আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। সেই গর্তেরই একটির মধ্যে থেকে মিলেছে একটি সোনার ভাঙা মুখোশ। মুখোশটি সোনার হালকা পাতে তৈরি। সেটি চিনের সাং রাজবংশের আমলের। প্রায় ১০০ বছর আগে দক্ষিণ চিনের চেংদু শহরে স্যানশিংদুই স্থানটির খোঁজ পান স্থানীয় এক কৃষক। এরপর সেখানে শুরু হয় প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজ। এরপর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় হাজার হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সোনার মুখোশটি সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসের ধ্বংসাবশেষ, ব্রোঞ্জের মূর্তি ও একটি জেড ছুরি।
ছোট্টো এক পুঁতি
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
২০০০ সালের মাঝামাঝিতে আলাস্কার পূর্বাঞ্চলের মাটি খুঁড়ে ছোটো ছোটো পুঁতি পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেগুলো ইউরোপে তৈরি। গত জানুয়ারি মাসে ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, উত্তর আমেরিকায় প্রথম পৌঁছানো ইউরোপে তৈরি সামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ছিল সেই পুঁতিগুলি। গবেষণায় উঠে এসেছে, ওই পুঁতিগুলো ১৪৪০-১৪৮০ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় নেওয়া হয়। এর বেশ কয়েক বছর পর ১৪৯২ সালে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন কলম্বাস। গবেষকদের অনুমান, পঞ্চদশ শতকে ইতালির ভেনিস ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তখনই হয়তো ইউরোপ থেকে সিল্করোড ধরে চিনে পৌঁছায় পুঁতিগুলো। সেখান থেকে যায় রাশিয়ার একেবারে পূর্বাঞ্চলে। এরপর বেরিং প্রণালি পেরিয়ে আর্কটিক হয়ে উত্তর আমেরিকার পথ খুঁজে নেয়।
পাণ্ডুলিপির অংশ আবিষ্কার
চলতি বছরের মার্চে কয়েক ডজন মৃতসাগরের পাণ্ডুলিপির অংশ আবিষ্কারের খবর জানায় ইজরায়েল সরকার। পাণ্ডুলিপির খণ্ডাংশে বাইবেলের বাণী লেখা ছিল বলে জানা গেছে। ইজরায়েলের অধীনস্ত পশ্চিমাংশের জুডিয়ান মরুভূমি থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেগুলো খুঁজে পান।
৩ হাজার বছরের চিত্র
মার্চ মাসেই পেরুর প্রাচীন মন্দিরের দেওয়ালে খোদিত এক চিত্রের হদিস পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। চিত্রকর্মের বয়স প্রায় ৩ হাজার ২০০ বছর। ছবিতে রয়েছেন ছুরি হাতে এক মাকড়সা দেবতা। পেরুর উত্তরাঞ্চলের এই মন্দিরটি অবশ্য আবিষ্কার হযেছিল ২০২০ সালে। মন্দিরের বেশিরভাগ অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত।
অক্টাভিয়ানের মাথার প্রতিকৃতি
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
মে মাসে প্রাচীন রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্টাস অক্টাভিয়ানের মাথার প্রতিকৃতির খোঁজ মেলে। মার্বেল পাথরের তৈরি প্রতিকৃতিটি ২ হাজার বছরের পুরোনো। ইটালির ইসার্নিয়া শহরে একটি মধ্যযুগীয় প্রাচীর সংস্কারের সময় এই প্রতিকৃতির সন্ধান মেলে।
তৃতীয় লিঙ্গের যোদ্ধার দেহাবশেষ
যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চমকে দিয়েছে বিশ্ব |
গত আগস্টে সামনে আসে আরেকটি চমকপ্রদ খবর। ফিনল্যান্ডে প্রস্তর যুগের একটি কবর থেকে একজন যোদ্ধার দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। ডিএনএ বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ওই যোদ্ধা তৃতীয় লিঙ্গের ছিলেন।
ভ্যান গঘের চিত্রকর্ম
চলতি বছরের অক্টোবরে, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের অলিভ গ্রোভ চিত্রকর্ম সংক্রান্ত নতুন আবিষ্কারের কথা জানায় ডালাস মিউজিয়াম অব আর্ট। একটি ছবির রঙের উপরে একটি পোকার লেজ আটকে আছে। সেটি দেখেই কোন স্থানে বসে ছবিটি আঁকা হয়েছিল তার খোঁজ চলছে।
পঞ্চবিংশ শতকের মন্দির
গত নভেম্বরে মিসরে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চবিংশ শতকের একটি মন্দির খুঁজে পান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সাড়ে ৪ হাজার বছরের পুরোনো মন্দির এটি। অনুমান করা হচ্ছে, মিসরের হারিয়ে যাওয়া সূর্য মন্দিরের একটি অংশ এই মন্দির। মিসরের রাজধানী কায়রোর দক্ষিণে আবু গোরাবের পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ একটি এলাকায় এই সূর্য মন্দিরটির আবিষ্কৃত হয়। মন্দিরের ভেতর বিশাল উঠানের মতো খালি জায়গা রয়েছে। এ ছাড়া ভেতরে রয়েছে বিশাল লম্বা একটি স্তম্ভ। সেখানেই মিলিত হয়ে সূর্যের আরাধনা করা হতো।
হাঙ্গামা ২৪