Sohel Rana : কিংবদন্তী নায়ক সোহেল রানাই প্রথম মাসুদ রানা

সোহেল রানাই প্রথম মাসুদ রানা
সোহেল রানাই প্রথম মাসুদ রানা

কিংবদন্তী নায়ক সোহেল রানাই প্রথম মাসুদ রানা


১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। সদ্য ভূমিষ্ট দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ যা আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে। আর এর প্রযোজক হিসেবে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। শুধু প্রযোজক হিসেবেই নয় অভিনেতা, পরিচালক এবং সংগঠক হিসেবেও সফল তিনি।

একদিন সোহেল রানাকে চলচ্চিত্র সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী বলেন, ‘তুমিই হবে মাসুদ রানা। মাসুদ রানার গুণাগুন তোমার মধ্যে বিদ্যমান।’ তিনিই তখন নায়ক হিসেবে মাসুদ পারভেজের নাম দেন ‘সোহেল রানা’। পরবর্তীতে ড্যাশিং হিরো উপাধিও দিয়েছেন আহমদ জামান। ‘মাসুদ রানা’ নামের সিনেমাটির মাধ্যমেই দর্শকরা সোহেল রানাকে নায়ক হিসেবে বড় পর্দায় প্রথম দেখতে পান। বহুল জনপ্রিয় এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার ব্যক্তিগত জীবন, চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে তার সাথে আলাপ করেছেন সাংবাদিক ‘আলাউদ্দীন মাজিদ’। হাঙ্গামা ২৪-এর পাঠকদের জন্য সে আলাপন তুলে ধরা হলো।

সোহেল রানা
সোহেল রানা



আলাউদ্দীন মাজিদ : প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ -এর নির্মাতা হিসেবে আপনার অনুভূতি--

সোহেল রানা : মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে আমি ও আমার বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলাম এবার কী করব? এর মধ্যেই মাথায় এলো চলচ্চিত্রের কথা। সবাই ভাবলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র। সে ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রে নাম  লিখালাম। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে চাষী নজরুল ইসলামকে দিয়ে নির্মাণ করালাম ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটি। ‘ওরা ১১ জন’ মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। একে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলা যাবে না। কারণ, এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনের নানা বাঁক, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের নানা কথা উঠে এসেছে। তাই আমি একে অন্য ১০টির মতো ছবি বলতে চাই। 

আলাউদ্দীন মাজিদ : যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন--

সোহেল রানা : ১৯৬১ সালেই ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হই। ১৯৬৫ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফার ঘোষণা দেন তখন থেকেই ছাত্রলীগের সবাই মিলে ৬ দফার প্রচার, প্রসারে ভূমিকা রাখতে শুরু করি। ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার ইকবাল হলে চলে আসি। তখন এই হল ছিল ছাত্রলীগের হেডকোয়ার্টার। এখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাকসহ সবাই আসতেন। ঢাকার সব কলেজ থেকে নেতারা আসতেন এবং ৬ দফা নিয়ে আলোচনা ও সভা করতেন। এ কারণেই ৬ দফা দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর জাতির জনকের অনুপ্রেরণায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। নিজের জীবন বাজি রেখেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।

আলাউদ্দীন মাজিদ : যুদ্ধের সে দিনগুলোর কিছু কথা বলুন --

সোহেল রানা : সে দিনগুলোর কথা তো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। টানা ৯ মাস হানাদারদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো শিউরে উঠি। আমি হয়তো আজ বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষকে দেখেছি রাস্তায় মরে থাকতে। নির্মমভাবে কত মানুষ না খেয়ে, পুড়ে, ধর্ষিত হয়ে মারা গেছে। যুদ্ধের সে দিনগুলোর কথা মনে হলে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আসলে আমরা কতটা নির্যাতিত ছিলাম।

আলাউদ্দীন মাজিদ : মুক্তিযুদ্ধের ছবি তেমনভাবে নির্মিত না হওয়ার কারণ কি বলে মনে করেন?

সোহেল রানা : বেশ কয়েকটি ছবি নির্মিত হয়েছে। কিছু কিছু ছবিকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সঠিক ইতিহাসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র খুব বেশি নির্মিত হয়নি। তা ছাড়া এখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যুদ্ধের সময়কার সরঞ্জাম পাওয়া যাবে না। পরিবেশও নেই। বর্তমানে দেশে যুদ্ধকালীন পরিবেশ তৈরি করা কঠিন ব্যাপার। এ কারণে শতভাগ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।

আলাউদ্দীন মাজিদ : মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিযোগ বা অভিমান?

সোহেল রানা : আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা তা পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এখনো তাঁদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। আমি মনে করি, ‘মুক্তিযুদ্ধ ভাতা’ নয়, দিতে হবে সম্মান তথা সম্মানী। মুক্তিযোদ্ধারা এখনো এয়ারপোর্ট বা কোথাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান পান না। তাঁদের হাসপাতাল থেকে শুরু করে সব স্থানে এখনো লাইনে দাঁড়াতে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, গাড়ি, পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে কোনোরকম সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া সবাই অবহেলিত। একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাওয়াটা অধিকার, দয়া নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভিআইপি কার্ড চেয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে, পেলাম না। দুঃখ, বিভিন্ন সেক্টরে সিআইপি মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের কেন সম্মান দেওয়া হচ্ছে না? ভিআইপি কার্ড থাকলে সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা সম্মান পেতেন, সম্মানীর কোনো প্রয়োজন নেই।

আলাউদ্দীন মাজিদ : কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?

সোহেল রানা :  বঙ্গবন্ধু চারটি পিলারের ওপর দেশকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। পিলার চারটিকে বলা হতো ‘মুজিববাদ’, যা আজকের অনেক মন্ত্রী-এমপি কিংবা রাজনীতিবিদ জানেন না। এই ‘মুজিববাদ’ শব্দটি আজকাল শোনাও যায় না। এখন সবাই শুধু বঙ্গবন্ধুর কালো কোটে ঢুকে গেছেন। এখনকার রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্ম নেই। শুধু স্বার্থ হাসিলের জন্য তাঁর নাম ব্যবহার করা হয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি চাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হোক।



আলাউদ্দীন মাজিদ : যেভাবে নায়ক হলেন তার পেছনের গল্পটা....?

সোহেল রানা : ‘মাসুদ রানা’ শিরোনামের ছবিতে নায়ক হিসেবে অভিষেক আমার। মজার ব্যাপার হলো ‘মাসুদ রানা’ ছবির প্রধান চরিত্রের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো। চরিত্র নির্বাচনের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা এস এম শফি, অভিনেত্রী সুমিতা দেবী, আমাকে আর চলচ্চিত্র সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। সারা দেশ থেকে অনেকেই ছবি পাঠালেন ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রটির জন্য। কিন্তু ঘটল মজার ঘটনা। এস এম শফি, সুমিতা দেবী আর আহমদ জামান চৌধুরী হঠাৎ এক দিন আমাকে বললেন, ‘তুমিই হবে মাসুদ রানা’। আহমদ জামান চৌধুরী তখনই নায়ক হিসেবে আমার নাম ঠিক করলেন ‘সোহেল রানা’। এরপর আহমদ জামান চৌধুরীই আমাকে ড্যাশিং হিরো উপাধি দেন। এ ছবিটি মুক্তির মাধ্যমে দর্শকরা আমাকে প্রথম নায়ক হিসেবে বড় পর্দায় দেখতে পান ১৯৭৪ সালে। এ ছবির মাধ্যমেই আমি প্রথম একসঙ্গে নায়ক, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে কাজ করি। এছাড়া প্রায় পৌনে ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছি। 


একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার লাভসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাও লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আশির দশকে ছোট ভাই রুবেলকে নায়ক করে শহীদুল ইসলাম খোকনকে দিয়ে নির্মাণ করি ‘লড়াকু’ ছবিটি। যা বক্স অফিসে ঝড় তোলে আর বাংলার দর্শকরা দেশীয় মার্শাল আর্টভিত্তিক ছবি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। বাংলা চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্ট ও কুংফুর প্রবর্তক ছিলাম আমিই। চলচ্চিত্রের নানা সংগঠনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে এ অঙ্গনে প্রাণসঞ্চার করার চেষ্টা করি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রযোজক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম। এ ছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, দুবার প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি, দুবার পরিচালক সমিতির সভাপতিসহ নানা সময় চলচ্চিত্রের কল্যাণে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করি। চলচ্চিত্র শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা তৈরিতেও অবদান রাখার চেষ্টা করি। শিল্পী রুবেল, জুলিয়া, সোহানা, অঞ্জনা, ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরাসহ অনেক জনপ্রিয় তারকা, কণ্ঠশিল্পী আজাদ রহমান, সেলিনা আজাদ, ক্যামেরাম্যান হাসান, চিত্র সম্পাদক জিন্নাত, চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম খোকন, শামসুদ্দিন টগর, আবুল খায়ের বুলবুল, মারুফ হোসেন মিলনসহ অনেককেই চলচ্চিত্রে নিয়ে আসি, পরে যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন।


আলাউদ্দীন মাজিদ : আপনার প্রযোজিত ছবিগুলো কি কি?

সোহেল রানা : আমার প্রযোজিত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- গুনাহগার, জবাব, এপার ওপার, জীবন নৌকা, যাদুনগর, নাগপূর্ণিমা, লড়াকু, বীর পুরুষ, বজ্রমুষ্টি, ঘেরাও, চোখের পানি, টপ রংবাজ, ঘরের শত্রু, শত্রু সাবধান। এছাড়া প্রায় অর্ধশত ছবি পরিচালনা করেন তিনি। 

আলাউদ্দীন মাজিদ : আপনার এমন কোনো ইচ্ছে আছে, যা আপনি চান?

সোহেল রানা : আমার জন্ম ১৯৪৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়। জন্ম ঢাকায় হলেও পৈতৃক নিবাস ছিল বরিশাল জেলায়। স্ত্রী ডা. জিনাত পারভেজ এবং একমাত্র সন্তান মাশরুর পারভেজ জীবরান। পুত্র জীবরানও চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রযোজক কামাল পারভেজ ও নায়ক রুবেল আমার ভাই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে এমএ পাস করি। পরে এলএলবি করলেও ১৯৬৯ সালে ৬ দফা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণে এলএলবি কমপ্লিট হলেও ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি আমার। আসলে আমার জীবনে এখন আর কোনো অপূর্ণতা নেই। আমি প্রকৃত অর্থে একজন সুখী মানুষ। তবে জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা দেখে যেতে পারলে শান্তিতে চির ঘুমে ঘুমিয়ে যেতে পারব।

হাঙ্গামা ২৪

সব খবর সবার আগে জানতে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url