নেই দুটি পা; তবুও চ্যাম্পিয়ন জেনিফার

জেন ব্রিকার
জেন ব্রিকার - Jennifer Bricker

শরীরের উপরের অংশ দেখলে অনেকেই ভাববেন হয়তো তিনি বসে আছেন। কিন্তু না, আসলে তার শরীরের নিচের অংশটুকুই নেই। দুই পা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেন জেনিফার ব্রিকার। তিনি জেন ব্রিকার নামেই বেশি পরিচিত। জন্ম থেকে দুই পা ছাড়া এই মানুষটিই বর্তমানে সবার অনুপ্রেরণায় রুপ নিয়েছেন।


রোমানিয়ান অভিবাসী দম্পতির ঘরে জেনিফারের জন্ম হলেও বাবা-মায়ের আদর স্নেহ কখনোই স্পর্শ করেনি তাকে। কারন জন্মের পরপরই বাবা-মা তাকে হাসপাতালে ফেলে রেখেই চলে যান। আসলে জিনগত ত্রুটির কারণেই গর্ভকালীন সময় পা তৈরি হয়নি জেনের। তার বাবা-মায়ের কাছে প্রতিবন্ধী শিশুকে বড় করার জন্য যথেষ্ট অর্থ বা বীমা ছিল না বলেই তারা শিশুটিকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যান। পরের দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে জেরাল্ড-শ্যারন দম্পত্তির বাড়িতে দত্তক দিয়ে দেয়।

জেন ব্রিকার
জেন ব্রিকার

শ্যারন ব্রিকার দত্তক নেওয়া মেয়েটির পা নেই সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের সন্তানের মতোই তাকে মানুষ করেন। জেরাল্ড ও শ্যারন দু’জনই কখনও জেনের পা না থাকার বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। তারাই জেনের নাম রাখেন জেনিফার।


তারা প্রতিবন্ধী হিসেবে নয় বরং নিজেদের ৩ ছেলের মতো করেই ভালোবেসে বড় করেন জেনকে। তিন বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিশে জেন অনেকটা টমবয় হয়ে ওঠেন। জেনের বয়স যখন মাত্র ৭ বছর তখন তিনি সফটবল টিমের ক্যাচার ছিলেন। দুই পায়ে দৌড়ানোর চেয়েও দ্রুত গতিতে জেন দু’হাত দিয়ে চলতে পারতেন।


এরপর তিনি বাস্কেটবল ও ভলিবলও খেলতেন। তবে তার ভালোবাসা ছিল ট্রাম্পোলিন ও টাম্বলিং। ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে মার্কিন অলিম্পিক জিমন্যাস্টিকস আটলান্টায় স্বর্ণপদক জিতেন। সেখানকার ১৪ বছর বয়সী জিমন্যাস্ট ডমিনিক মোসেনুর সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ আমেরিকান জিমন্যাস্ট হিসেবে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। এর পর ডমিনিকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ৮ বছর বয়সী জেন জিমন্যাস্টিক্সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। শরীরচর্চায় আগ্রহী দেখে তার মা তাকে এক মাইল দূরের একটি জিমে নিয়ে যান।


মাত্র ১০ বছর বয়সেই সাধারণ মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করেও জেন ভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটনে এএইউ জুনিয়র অলিম্পিকে ৪তম স্থান অর্জন করেন। এক বছর পরে, তিনি ইলিনয় পাওয়ার টাম্বলিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন। এরপর ইউএস টাম্বলিং অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক অনুপ্রেরণা পুরস্কার পান।

জেন ব্রিকার
জেন ব্রিকার

১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে ডমিনিক মোসেনু যখন পারফর্ম করছিলেন, তাকে দেখে জেনের মা শ্যারন ব্রিকার সন্দেহ করেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো জেনের সঙ্গে ডমিনিকের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। এরপর তিনি হাসপাতালের দত্তক নেওয়া কাগজে দেখতে পান জেনের বাবা-মায়ের নামের শেষে মোসেনু পদবী আছে।


তিনি আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পানে, ডমিনিক মোসেনু জেনের আপন বোন। তখনই বিষয়টি জেনকে জানাননি তার মা। অলিম্পিকের ৮ বছর পর তখন জেনের বয়স ১৬ বছর। একদিন কৌতূহলবশত জেন তার বাবা-মা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই শ্যারন ব্রিকার তাকে বলেন, ‘তোমার পরিবারের শেষ নাম হলো মোসেনু। সেই অর্থে ডমিনিক মোসেনুই হলো তোমার বোন।’


যাকে দেখে জেন নিজেকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে গড়ে তুলেছেন, তিনি আসলে নিজেরই বোন। এই বিষয়টি ভাবতেই অবাক হচ্ছিলেন জেন। কয়েক মাস পরে জেন তার জন্মদাতা মাকে ডেকে আনেন। সে তার মাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি ১৯৮৭ সালে দত্তক নেওয়ার জন্য একটি মেয়েকে ছেড়ে দিয়েছিলেন হাসপাতালে?’

জেন ব্রিকার
জেন ব্রিকার

এই প্রশ্নে জেনের গর্ভধারিণী মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর তার মাধ্যমেই জেন তার আইডল ও বোন ডমিনিককে ডেকে পাঠান। এই চ্যাম্পিয়নও হারানো বোনকে পেয়ে বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। কারণ তিনিও জানতেন না এই বোনের কথা। ৪ বছর পর দুই বোন অবশেষে এক হন।


বর্তমানে জেন ব্রিকার লস এঞ্জেলেসে থাকেন। তিনি অ্যাক্রোব্যাটিক ও এরিয়াল শো অভিনেতাদের একজন। তিনি নিয়মিত বিশ্ব ভ্রমণ করেন। তিনি তার প্রতিভা হাজারও মানুষের সামনে আজ প্রদর্শন করেন। তাকে দেখে সবাই অনুপ্রেরণা পায়। পা না থাকা স্বত্বেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন জেন ব্রিকার।


‘এভরিথিং ইজ পসিবল: ফাইন্ডিং দ্য ফেইথ অ্যান্ড কারেজ টু ফলো ইওর ড্রিমস’ অর্থাৎ, ‘সবই সম্ভব: স্বপ্নগুলো অনুসরণ করুন বিশ্বাস ও সাহসের খোঁজে’ বইটিতে নিজের জীবনের সব ঘটনা লিখেছেন জেন।

জেন ব্রিকার
জেন ব্রিকার

ডোমিনিক বাউয়ার নামক এক ব্যাক্তি জেনের বই পড়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তারা ফোন ও ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। ২০১৯ সালের মার্চে বাউয়ার প্রেমের প্রস্তাব দেন জেনকে। তারা একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করেন।


এরপর ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের উপস্থিতিতে গাঁটছড়া বাঁধেন জেন ব্রিকার ও ডোমিনিক বাউয়ার। বিয়ের সময় ব্রিকারের বয়স ছিল ৩১ বছর ও তার স্বামী বাউয়ারের বয়স ছিল ২৬ বছর। জেন ব্রিকারের বয়স বর্তমানে ৩৩ বছর।


হাঙ্গামা বাংলা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url